বৃহস্পতিবার, ১০ ফেব্রুয়ারী, ২০১১

ধুর্জটি চন্দ লিখিত 'সুবিমল বসাকের উপন্যাস ছাতামাথা'

 (বাংলা সাহিত্যে পূর্ববঙ্গের ভাষায় রচিত [ ১৯৬৫ সালে ] প্রথম উপন্যাস ছাতামাথা  গ্রন্হের আলোচনা )


গত শতাব্দীতে বাংলা সাহিত্যে যে-উল্লেখযোগ্য আন্দোলনটির প্রভাবে সারা বাংলা তথা ভারতবর্ষ আলোড়িত হয়েছিল, যার ছায়া ক্রমশ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে আজও, সেই হাংরি জেনারেশন মুভমেন্ট-এর অন্যতম শরিক সুবিমল বসাক, একজন সুচারু ভাষাশিল্পী, একথা আজ অবশ্যমান্য।
'ছাতামাথা' নামে একটি অনন্যসাধারণ গ্রন্থের প্রণেতা তিনি। প্রকৃতপক্ষে এই গ্রন্হপাঠে আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছি। বস্তুত আলজিভ দিয়ে লেখা উপণভাসের স্বাদ গ্রহণে আমার জিভ অনভ্যস্ত। উল্লেখযোগ্য, গ্রন্হটি আগাগোড়া পূর্ববঙ্গের ভাষায় লেখা। মুখে-মুখে ডায়ালেক্ট ব্যবহার করা হয়ে থাকে সেই ভাষায়। এই গ্রন্হ আঞ্চলিক ভাষায় লেখা হয়ে থাকলেও আঞ্চলিক নয়। প্রমথ চৌধুরীর পর বাংলাদেশে গদ্য সাহিত্যে কমলকুমার মজুমদার এবং তারপর সুবিমল বসাক এক নতুন জোয়ার আনলেন। তাছাড়া এ-যাবৎ অনেক উপন্যাসই লেখা হয়েছে যা কিনা আঞ্চলিক উপন্যাস নামে অভিহিত। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'হাঁসুলিবাঁকের উপকথা', 'নাগিনীকন্যার কাহিনী'; সতীনাথ ভাদুড়ির 'ঢোঁড়াই চরিতমানস', অমিয়ভূষণ মজুমদারের 'গড় শ্রীখণ্ড' ইত্যাদি। কিন্তু আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করা সত্বেও এই গ্রন্হ যে ক্ষুদ্র অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, এক আধুনিক, অভূতপূর্ব সার্থক উপন্যাস হতে পেরেছে তা সুবিমলের পাওয়ার অফ অবজারভেশন ও বুদ্ধিকে মগজ থেকে গোড়ালিতে আনার এক মহৎ ফলশ্রুতি।
আরো আশ্চর্যভাবে লক্ষ করা যায় --- এখানে সংলাপ চলিত ভাষায় ব্যবহার করছেন এবং ভাষা-ভূমি পূর্ববঙ্গের। মৃনাল সেনের ভূবন সোম হিন্দিতে কথা বলেছেন বটে, কিন্তু যখনি তিনি চিন্তা করেছেন ভিতরে-ভিতরে, আমরা ভুলি না ভূবন সোম বাঙালি চরিত্র। আমার শরীরে ঢাকার নীল রক্ত থাকা সত্বেও সুবিমল বসাকের এই গ্রন্হপাঙে আমাকে বেশ পরিশ্রম করতে হয়েছে। যারা এই দেশীয়, পূর্ববঙ্গীয় নন, তাঁদের পক্ষে এগ্রন্হ উদ্ধার করা শ্রমসাপেক্ষ। এ-গ্রন্হ চলিত ভাষায় লেখা হলে আরও বেশি পাঠক রসগ্রহণে সক্ষম হতেন এবং আধুনিকতা সম্পর্কে সচেতন হতেন বলে আমার বিশ্বাস। সর্বোপরি, বলা যায়, এই গ্রন্হপাঠে এক অদ্ভুত জগতের আবিষ্কার হয়।
আটটি অংশে বিভক্ত এই গ্রনহটিকে উপন্যাস নামে অভিহিত করা হয়েছে। উপন্যাস বলে এতদিন আমরা যা বুঝে এসেছি, এ গ্রন্হ তা নয়। এর প্রত্যেকটি অংশই খাপছাড়া। ১নং গদ্যের সঙ্গে ২নং গদ্যের কোনো মিল নেই, ২নং গদ্যের সঙ্গে ৩নং, ৩নং এর সঙ্গে ৪নং গদ্যের কোনো মিল নেই, এই খাপছানো ভাব এই গ্রন্হে আগাগোড়া। অথচ একটি যোগসূত্র এই গ্রন্হের নায়ক 'আমি'। এই 'আমি'কে কেন্দ্র করেই সুবিমল দেখিয়ে দিয়েছেন কিভাবে চিতায় শুয়ে মুখাগ্নিরত শোকাতুর হাতকে কামড়ে ধরতে হয়।
্র নায়ককে দেখি গোঁয়ার, গবেট, একমুখী, অভিমানী, সেন্টিমেন্টাল -- যে বিহ্বল, বিমূঢ় হয়ে গেছে সমাজের ব্যবহারে, মানুষের ব্যবহারে, বন্ধুবান্ধবীর ব্যবহারে। কখনও সে ক্রোধে ফেটে পড়ছেকখনও নিজের ভুলের জন্য হাত কামড়াচ্ছে, হাঁটু মুড়ে ক্ষমা চাইছে, কখনও বা ক্ষুব্ধ হচ্ছে। যা চাইছে তা ঘটছ না, যা ঘটছে তা কখনওম করেনি, বিচার হওয়ার পূর্বেই সে অপরাধী বলে প্রমাণিত, অথচ কিসের অপরাধ তা সে জানে না। এই ধরনের নেপথ্য কাহিনী আজও দেখতে পাই। সুবিমলের এই গ্রন্হ পড়তে-পড়তে মাঝে-মাঝে আমার মনে হয়েছিল যে এই পৃথিবীটা ট্যান্টালাসের নরক।( গ্রিক পুরাণে ট্যান্টালাস নামে এক রাজার কাহিনী লিপিবদ্ধ আছে। দেবতার অভিশাপে তিনি পাতালে নিক্ষিপ্ত হলেন। সেই পাতালে থেকে তিনি ক্ষুধার্ত এবং তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়েন। অমনি তার চোখের সামনে নানাবিধ ফলমূল ঝুলিয়ে ধরা হল। তিনিও অমনি হাত বাড়ালেন। কিন্তু আশ্চর্য! সঙ্গে-সঙ্গে ফলমূল উধাও হল।ঝরণার বারি দেখে তিনি হাঁ করলেন। কিন্তু সঙ্গে-সঙ্গে তাও অদৃশ্য হল।এই ভাবে ট্যান্টালাস ক্ষুধা-তৃষ্ণায় তিলে-তিলে মারা গেলেন। গ্রিক পুরাণে এটাকেই ট্যান্টালাসের নরক বলা হয় ) বাস্তবিকই তা। যাদের শরীরে এখনও আলপিন গেঁথে গেলে যন্ত্রণা হয় ----- অর্থাৎ চামড়া এখনো মোটা হয়নি ----- তারা প্রত্যেকে প্রতি মুহূর্তে এর সত্যতা উপলব্ধি করেন। কাজেই এটা স্বাভাবিক, সুবিমল ভিক্টিম।জন্মের পরমুহূর্ত থেকে একটি শিশু যেমন ট্র্যাপের ভিতর সেঁধিয়ে পড়াছে ----- এবং সে জানে না তাকে কে কোনদিক থেকে ঠেসে ধরতে চায়। যেমন 'তুলো জানে না তাকে কোন রঙে ছুপিয়ে কার দলের পতাকা করা হবে'।
'ছাতামাথা-র কোনো-কোনো অংশ জার্কিঙের কাজ করে। মগজকে চমকিত করে তোলে। পড়তে-পড়তে হাত বুকের ওপর চলে আসে। দীর্ঘশ্বাস বের হয়। Contemplation is engulfed by action, যারা এ-ধারণা পোষণ করেন, সুবিমলের এই গ্রন্হ তাদের মগজ ধোলাই করতে সাহায্য করবে। Contemplation এবং Actionকে সুবিমল সব্যসাচীর মত কাজে লাগিয়েছেন। ৪নং অংশে যে-ভয়ংকর মুহূর্তের বিশেষ অবতারণা করেছেন --- জীবনে যে-সব ভয়াল পরিণতি অধবা পরিণতির সেই সব ভয়াল মুহূর্ত --- অর্থাৎ মুহূর্ত-বিশেষের পরিবেশ, সেই সব ঘটনা জীবন থেকে বিতাড়ন অসম্ভব।শরীরের চামড়া থেকে গর্ভের গন্ধ সরানো সম্ভব নয়, এবং এরই ধাক্কায় ফেটে পড়ে নানান বোধ --- নিঃসন্দেহে এক নতুন ও ভয়ংকর লেখা । কিংবা ৭নং অংশের লেখা। এধরণের লেখার সঙ্গে পূর্বে কেউ পরিচিত ছিলেন কি না আমার জানা নেই। সুররিয়্যালিজম ন্দোলনে 'অটোমেটিক রাইটিং' -এর প্রচলন ঘটেছিল । এই অংশ সেই বিশেষ লেখন-প্রক্রিয়াকে মনে করিয়ে দেয়। মানুষের টোটালিটি অর্থাৎ একজন মানুষের ভিতর যা থাকে --- ব্যক্তিগত লোভ, হিংসা, মোহ, প্রজানীতি, আতঙ্ক, কপটতা, ভালবাসা, উন্মাদনা, ট্রিকস, ধর্মবোধ, ল্যাং মারামারি, উদারতে, মিননেস, সাধুতা, ছ্যাঁচড়ামি, ঈর্ষা, সাফোকেশান ( গেরিলা আক্রোশ ) সবই হাজির হয়। তাই সুবিমলকে কখনো নিষ্ঠুর, কখনো বিবেক যন্ত্রণায় আক্রান্ত, কখনো অপরিচিত দেখি। হোটেলে একটি মেয়ের মাথা কাপড়ে পাক দিয়ে ঠেসে আগলা নগ্ন শরীরের প্রতি তার মন্ত্রোচ্চারণ চলে --- সবিতা, চন্দ্রাবতী, শকুন্তলা, নীহার, অণিমা, শর্মিলা ও অরুন্ধতী.... ধরা পড়ে যায় চালাকি। নারীর মগজ বাদ দিয়ে শারীরিক প্রয়োজনীয়তা একই --- একথা বোঝার পরে কিছুই থাকে না। কিংবা নায়কের ৫৬৭৮৯-এ রূপান্তরিত হওয়া । 'ক' বাবু জীবনের সঙ্গে আপোস করতে গিয়ে একের পর এক জিনিসের ব্যবহার --- দুরবিন, ডাইরি, গ্রামোফোন --- এই সব উঠে আসে মানুষের কাছে ঘুষের মত। এবং এসবের যখন প্রয়োজন থাকে না, অর্থাৎ জীবনে বেঁচে থাকার মত কোনো কারণ থাকে না --- শিশিরের শব্দের মত সন্ধ্যা নেমে আসে। সুবিমল যখন লেখেন, "গতর থিক্যা হগল সংস্কারের ধুলা ঝাইড়্যা ফেলছি--- তবুও পিরান থিক্যা বাইরাইতে পারি না --- নারীর কাছে সর্বস্ব সমর্পণ করেও প্রতারিত, বিভ্রান্ত, সংস্কার কাটিয়েও বেরোতে পারছেন না, তখন খুব স্বাভাবিক ভাবেই আমার স্টেফানোৎসভাইকের  Twenty four hours in the life of a woman মনে পড়ে। সুনু ওরফে কৃষ্ণা একজন নারী। এই নারীকে কেন্দ্র করে সুবিমল তাঁর চারপাশ খুঁটিয়ে দেখেছেন। নারী নিয়ে সাহিত্যে এমনকিছু লিখলে ন্যাকামি হয়, কিন্তু জীবনে নারীর প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না।পিকাসোর ব্লু পিরিয়ডের মত এটাও তাঁর রেড পিরিয়ড। হাহাকার, নিজের অপদার্থতা, ভুল জায়গায় নির্ভুল ভালবাসা, ভুল রমণীকে হৃদয় দান --- এই সব রেড পিরিয়ডে দেখা যায়। তাছাড়া লেখায় ভয়ংকর ব্যাপার থাকা সত্বেও এক কবিত্ব লক্ষ্য করা যায়। সম্ভবত আঞ্চলিক ভাষায় বলেই কবিত্ব ফুটে ওঠে কোথাও-কোথাও।
সুবিমলের এই stream of consciousnessকে ভয়ংকর সুন্দর বলে মনে হয়। আঞ্চলিক ভাষায় এটা যেন স্বতঃস্ফূর্ত------- "আমি যেই রাস্তা দিয়া চিলি ফিরি, অন্যেরা হেই রাস্তা দিয়া চলাফিরা করে না। আমার রাস্তাঘাত এক্কেরে আপনরাস্তা । আমি যা দেহি, অন্যেরা হেই লেহান দ্যাহে না। মাঠ-ময়দানের ঘাস আমার চোহে লালবর্ণ ----- অন্যেরা দ্যাহে হইলদা। আমি যারে দেহি রক্ত, অন্যেরা দ্যাহে পানি, আমি যারে কই হেজ, অন্যেরা কয় কব্বর।"
এরপর আর মোরাভিয়ার  Dialect is an inferior form of expression because it is less cultivated form--- এই উক্তি খাটে না। অবশ্য মোরাভিয়া যদি বাঙালি হতেন, তাহলে নিজেই তাঁর ধারণা পালটে ফেলতেন বলে আমার বিশ্বাস।
( ছিটেফোঁটা পত্রিকার বইমেলা ২০০০ সুবিমল বসাক সম্বর্ধনা সংখ্যা থেকে পুনঃপ্রকাশিত )

বুধবার, ৯ ফেব্রুয়ারী, ২০১১

অজয় সেন লিখিত 'হাবিজাবি, বকবকানি ও খোলা জানলা'

সুবিমল বসাকের সাথে প্রথম আলাপ কলেজ স্ট্রীটের 'বিভূতি কেবিনে'। সেখানে শৈলেশ্বর, বাসুদেব, সুভাষ অনেকেই আসত, কাছাকাছি কফিহাউস থাকা সত্তেও 'বিভূতি কেবিন' তাদের অনায়াসে সাঁতরানোর জায়গা ছিল।১৯৬৩-৬৪-এর ওই  আড্ডাখানায় শুনতাম বেশি, লক্ষ্য করতাম বেশি হাংরির নব্যযুবকদের, এদের মধ্যে আমার কাছে আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ছিল বাসুদেব দাশগুপ্ত ও সুবিমল বসাক। পরে সুবিমলের সঙ্গে অন্তরঙ্গতার কারণে এক ধরণের ভালোলাগা জন্ম নিয়েছিল, বলা বাহুল্য, আজও যা চিড় খায়নি এতটুকু। ওর অফিসে গিয়ে অনেক দিন অনেক সময় কাটিয়েছি, ডিপার্টমেন্টের প্রত্যেকটি কর্মচারীর নাম. কে কি রকম, কার কি দুর্বলতা, কি কি গুণ খুঁটিনাটি আমাকে সে বলত নিচুস্বরে, চা খেতে-খেতে এই সব গল্প হত আমাদের। আর যে আলোচনার মধ্যে এসব কিছুই থাকত না, তা হল লেখালিখি। সে নিজেরই হোক বা অপরেরই হোক। বিশেষ করে অপেক্ষাকৃত তরুণদের লেখালিখি সুবিমল বেশ মনোযোগ দিয়েই পড়ত, যেটা আমার তাকে ভালো লাগার কারণ। কে কোথায় একটা ভালো লেখা লিখেছেন, সেই লেখার সমালোচনা করে ভালো কি মন্দ অনায়াসে জানিয়ে দিত। আমার লেখা যে সে পছন্দ করে তা প্রথম দিন আলাপের পরই জানিয়েছিল, অবাক হয়েছিলাম বেশ খানিকটা। মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন হয়েছিলাম এই কারণে সদ্য লিখতে আসা নব্য যুবককে উৎসাহ ও প্রচ্ছন্ন সাহস যোগানোর জন্য।
সুবিমল বসাক প্রকৃত অর্থে ছাই-চাপা আগুন। সে সময় হাংরি আন্দোলন ঝড় তুলেছিল দেশে তো বটেই, বিদেশেও তার ঝাপটা লেগেছিল, সে সময় পুতু পুতু রক্ষণশীলরা চেঁচামেচি শুরু করেন, ফলতঃ শ্লীল-অশ্লীল সাহিত্য রচনা করেছেন, সমাজের ভেজানো দরোজা একের পর এক খুলে দিচ্ছেন, তাদের এসব উদ্যম চিন্তাভাবনা ভালো লাগেনি প্রশাসন এবং এক শ্রেণীর ব্যাঙদের কাছে, ফলতঃ ধরপাকড়, হাজতবাস, কোর্টকাছারি অমোঘ হয়ে নেমে আসে হাংরি আন্দোলনের কবি-সাহিত্যিকদের ওপর। এদের মধ্যে অনেকে,( যেমন শৈলেশ্বর ঘোষ, সুভাষ ঘোষ ) মুচলেকা দিয়ে দেন, ভাবটা এমনই যে ওপাড়ায় আমি নেজে যাইনি, আমাকে ওরা নিয়ে গেছিলো। সুবিমল ও অন্য কয়েকজন নিজেদের মতই লেখালিখি করে গেছেন। কাউকে, কোনো কিছুকে তোয়াক্কা না করেই। সুবিমলের লেখার মধ্যে একটা প্রাদেশিক সাযুজ্য লক্ষ করি। গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ যেমন লিখেছেন, পাশাপাশি প্রাদেশিক কবিতা অনুবাদ এবং জীবনীগ্রন্হ রচনাতেও মাহিরিআনা দেখিয়েছেন। দুটো উপন্যাস, ছয়টি গল্প-গদ্য সংগ্রহ, দুটি কবিতার নিজস্ব চটি বই।প্রবন্ধ অনুবাদ করেছেন অনেক। অনুবাদ সাহিত্যে ২০০৭ সালে যশপাল রচিত অকাদেমি পুরস্কারে ভূষিত সুবিমল। যদিও তা অনেক আগেই পাওয়া উচিত ছিল।
সুবিমল বসাকের লেখালিখি --- প্রথম কবিতার বই 'হাবিজাবি' যখন প্রকাশিত, তখন হাংরি আন্দোলন তুঙ্গে। অধিকাংশ কবিতা ওই সময়ের লেখা, মনে হয় নিজের সম্পর্কে ভাবনা, সমাজের উঠোনে নিজেকে নগ্ন করে খতিয়ে দেখা, নিজের পরিবেশকে খুঁড়তে-খুঁড়তে নিজের সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিকোণ, ভাবনা আবিষ্কার করা। ফলতঃ কবিতাগুলোয় প্রেম-অপ্রেম, ভালোবাসা-ভালোবাসাহীনতা, চোরাস্রোতের মত চিন্তা, ঈর্ষা, স্নেহ, জীবন-পারাপার-ভাবনা, দুঃখকষ্ট, অবজ্ঞা-উপহাস, হতাশা, চিল-চিৎকার যাবতীয় ব্যাপার উঠে এসেছে ওই কবিতাগুলির মধ্যে।
আমি কবিতা পড়তে ভালোবাসি। কবিতার প্রতি আমার যথেষ্ট দুর্বলতা আছে, তো যেটা লক্ষ করি, 'হাবিজাবি' কবিতার বইয়ের মধ্যে, তা হলো ভাষা। সুবিমলের কথায় --- আমার মায়ের ভাষা। পূর্ববাংলার ভাষা তো মাটির ভাষা। এখন লক্ষনীয় 'মা' কোন অর্থে? দেশ-মা না গর্ভধারিণি-মা ? এক অদ্ভুত দেশজ কধ্য ভাষায় এরকম লেখা আমি কখনও পড়িনি। বাংলা সাহিত্যে কবিতার জগতে সুবিমল পাথ-ব্রেকিং।
১৯৭০ থেকে ২০০০ সালে প্রায় তিরিশ বছর বাদে দ্বিতীয় কবিতার বই 'বকবকানি' । মোট চব্বিশটি কবিতার চটি বই। রাজনীতি, ব্যাঙ্গ, যৌনতা, দার্শনিক স্ট্রিট রিয়্যালিটির পাশ কাটিয়ে এক মানভাষার আকুতি। 'বকবকানি' সে-অর্থে এক সার্থক দলিল। অবশ্য হাংরি আন্দোলনের বাঁকবদল ছিল উত্তরঔপনিবেশিক এপার-বাংলার ফসল। সমাজ তার নিজস্ব প্রক্রিয়ায় যে জীবনবোধ গড়ে দেয়, তা থেকে এই মোড়বদল আলাদা করা যায়। কবিতা ছাড়াও সুবিমল বসাক অত্যন্ত নিপুণভাবে গদ্য রচনা করেছেন; গদ্য সংগ্রহ যে কয়টি হাতে পেয়েছি, ইতস্তত পত্র-পত্রিকায় পড়েছি, মনে হয়েছে সুবিমল আরও গদ্য লিখতে পারতেন। তবে তিনি যে একজন সফল গদ্যকার এ-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তিনি হিন্দি কবিতার সঙ্গে পাঠকদের পরিচয় করিয়ে দেন 'প্রতিবেশি জানালায়'। অনুবাদ সাহিত্যেও সুবিমল যে মাহির তা বলাই বাহুল্য।
অনুবাদ সাহিত্যে গল্পের মধ্যে ফণীশ্বরনাথ রেণুর 'তিসরি কসম', শ্রেষ্ঠ গল্প প্রেমচন্দের 'পঞ্চ পরমেশ্বর', 'দুই সখী'। প্রবন্ধ অনুবাদের ক্ষেত্রে 'জীবনসার', হিন্দি কবিতার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সংকলন 'প্রতিবেশিন জানালা'। শ্রীকান্ত বর্মার 'উজ্জয়িনীর রাস্তা', জগদীশ চতুর্বেদীর 'বোবাদের পল্লীতে' যথেষ্ট দাগ কাটে পাঠকদের মনে, কারণ প্রত্যেকটি অনুবাদ-কবিতায় হাংরি কবিতার ঝলক উঁকি মারে। কবিতার জীবনকে সামলাতে না পারলে পড়ে যাবার সম্ভাবনা থেকেই যায় --- পাঠককুলকে তাই খবরদারি, সাবধানবাণী প্রকৃতই চেতাবনি। সুবিমল বসাক ঢাকায় গেছিলেন তাঁদের পৈত্রিক বাড়ির আশে-পাশে যে-সব বুজুর্গরা থাকতেন, তাঁদেরই সান্ধ্য আসরে তাঁদের অনুরোধে লুপ্তপ্রায় এক প্রাচীন শিল্পকলাকে তুলে ধরেছেন। ঢাকার হিন্দু বাঙালিদের 'বিয়ার গীত' ও 'ঢাকাই ছড়া' সংকলনে। খাস কলকাতায় বছর তিরিশ পূর্বেও বিবাহ উৎসবে এসব গানের প্রচলন ছিল, ক্রমশ হ্রাস পেতে-পেতে এসব গান আজ আর কোনো বিবাহ অনুষ্ঠানে শোনা যায় না, হয়তো আর্থ সামাজিক, শহুরে মানসিকতার সঙ্গে খাপ খায়নি, দ্বিতীয়ত এসব গানের উত্তরসূরী তাঁরা রেখে যাননি, তবু এখনও গ্রামাঞ্চলে কোনো প্রাচীনা, বিবাহ উৎসবে আনন্দে উত্তেজনায় গুনগুন করে গেয়ে উঠছেন এই সব গান।তা সুবিমল বসাকের অবদান।
হাংরি আন্দোলনের পুরোধা সুবিমল বসাক প্রকৃত অর্থে বহু বিচিত্র শিল্পগামী। এখনও তাঁকে লিখে যেতে ব্যক্তিগতভাবে অনুরোধ করি। তার কারণ তিনি জানেন এমন গদ্য অথবা কবিতা নেই--- যা পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম ঠাণ্ডাযুদ্ধও থামিয়ে দিতে পারে --- তাই সুবিমলকে অনুরোধ--- লিখুন, আরও লিখুন। থামিয়ে দিন পৃথিবীর ঙাণ্ডাযুদ্ধ ও উলঙ্গ বিবাদ।

ছিটেফোঁটা পত্রিকার বইমেলা ২০০০ সুবিমল বসাক সম্বর্ধনা সংখ্যা থেকে পুনঃপ্রকাশিত

মঙ্গলবার, ৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১১

কলিম খান লিখিত : সুবিমল বসাক, এক সুন্দর মানুষের কথা

"তোমার সঙ্গে যারা থাকে, তোমার বাবা মা জেঠা জেঠিমা কাকিমা মাসি পিসি ঠাকুরদা ঠাকুরমা ধাইমা দাদা দিদি বৌদি....এদের মধ্যে কে সবচেয়ে বেশি সুন্দর ?" --- এ প্রশ্ন যৌথ পরিবারে বাস করে এমন বাংলাভাষী শিশু-কিশোরীকে ( যাদের বয়স সাত-আট বছরের কম ) জিজ্ঞেস করলে বেশ অদ্ভুত উত্তর পাওয়া যায়। দেখা যায়, যাকে সে সবচেয়ে বেশি সুন্দর বা সুন্দরী বলে ঘোষণা করছে, অনেক ক্ষেত্রেই তার রূপলাবণ্য দৃষ্টিনন্দন বা বিউটিফুল নয়; অথচ তাকেই সে সুন্দর বা সুন্দরী বলছে ! তার মানে সুন্দর বলতে তারা রূপবান-রূপবতী বা বিউটিফুল বোঝে না, অন্য কিছু বোঝে।
বিষয়টি নিয়ে একটু এগোলে দেখা যায়, শিশু-কিশোরটি যাকে সুন্দর বা সুন্দরী বলছে, তার রূপ দৃষ্টিনন্দন বা দৃষ্টিকটু যাই হোক, সে আসলে শিশুটিকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসে। তার মানে, বাংলাভাষী শিশুদের ভাষাজ্ঞান অনুসারে যে ব্যক্তি তাকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসে, সে-ই সুন্দর বা সুন্দরী! এই লেখকও তার শৈশবে তার ঠাকুমাকেই বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর মহিলা বলে জানত। এমনও দেখা গেছে, পরিবারের সকলের অবহেলার মাঝে এক অতি কুরূপা দাসীর নিত্য পরিচর্যায় বড় হয়ে ওঠা শিশু তার সেই কুরূপা দাসীকেই 'সুন্দরী' বলে ঘোষণা করছে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় অনেকেই এই প্রকার সত্যের সন্মুখীন হয়ে থাকবেন। তার মানে, যাদের প্রতি শিশু-কিশোরদের ভালবাসা উৎসারিত হয়, তাদেরই তারা বিউটিফুল দেখে। সেক্ষেত্রে মানতেই হবে যে, মানুষের মনের রঙেই পান্না সবুজ হয় -- এই রবি-বাক্য এক্ষেত্রেও সক্রিয় রয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে আরও একটু এগোলে আর-এক সত্যের সন্ধান মেলে দেখা যায়, মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে, পুরাণাদি গ্রন্থে, গ্রামবাংলার মানুষের মুখের ভাষায় সুন্দর শব্দটি সাধারণভাবে বিউটিফুল অর্থে ব্যবহৃত হয়নি, হয় না। হয় না যে, তার অজস্র প্রমাণ চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। 'সুন্দর কথা', সুন্দর গান'... এসব তো আমরা বলি, এমনকি বঙ্গীয় শব্দকোষ রচয়িতা শ্রী হরিচরণ
বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ও জানাচ্ছেন যে--- কর্পূরমঞ্জরী গ্রন্থে একটি পদে রয়েছে 'সুন্দর শব্দাবলী': বিদ্যাসুন্দর গ্রন্হে রয়েছে 'সুন্দর নাম': বঙ্কিমচন্দ্রের গ্রন্হাবলীতে রয়েছে 'সুন্দর স্পর্শ', 'পরিতে সুন্দর', ঘ্রাণে সুন্দর'... ইত্যাদি। ইংরেজি ভাষাজ্ঞানীরা জানেন, ইংরেজিতে Beautiful words, beautiful name, beautiful to wear, beautiful to smell... এরকম শব্দবন্ধ রীতিসম্মত নয়। কিন্তু বাংলায় দেখা যাচ্ছে সেরকম শব্দবন্ধ কেবল তৈরিই করা যায় না, হয়ে থাকে, হয়ে আসছে বহুকাল ধরে। তার মানে বাংলা ভাষায় সুন্দর বা সুন্দরী শব্দের মানে শুধুমাত্র বিউটিফুল নয়, আরও অনেক কিছু। প্রশ্ন হল কী সেই 
মানে ?
বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ-এর কাজ করতে গিয়ে 'সুন্দর শব্দের সেই অর্থটি আমার চোখে পড়ে যায়। দেখি, 'সমুদ্র'এর মতো 'সুন্দর' শব্দটিরও জন্ম হয়েছে 'উন্দ' ক্রিয়ামূলের শব্দপরিবারে। [সু+/উন্দ+অর--কতৃবাচ্যে। উন্দএর মানে হল 'নিজের উচ্চতাকে কমিয়ে অন্যের সমান বা সমান্তরাল করা' বা 'সামঞ্জস্য বিধান করা' ( উ=উদগতি; ন= না-করণ; দ= পারিপার্শ্বিককে দান )। এই ক্রিয়া থেকে জাত ইঁদুর, ওল, সমুদ্র, সুন্দর, সুন্দরী, সৌন্দয্য প্রভৃতি কুড়িটি শব্দ নিয়ে গড়ে উঠেছে উন্দ-এর নিজস্ব শব্দপরিবার। সমস্ত প্রাচীন বাংলা অভিধান এই সাক্ষ্য দিয়ে থাকে। ইংরেজি wound শব্দটি এই পরিবারেরই সন্তান।] সেই সুবাদে সুন্দর শব্দটির ক্রিয়াভিত্তিক অর্থ হল -- 'সু-উন-দানের অস্তিত্ব রহে যাহাতে' । অর্থাৎ আপন শক্তির জোরে উপরে ওঠা গেলেও, উপরে ওঠাকে কমিয়ে পারিপার্শ্বিক সত্তাদের সেই শক্তি খুব ভালভাবে দান করে যে, সেই হল সুন্দর। তার মানে সুন্দর সে-ই, যে সর্বদা পারিপার্শ্বিকের সমান হওয়ার চেষ্টা চালায়, আপন উন্নয়ন থামিয়ে পরিপার্শ্বের উন্নয়নে যত্নবান হয়; যে যথার্থে সামঞ্জস্যমূলক সমানতায় বিশ্বাসী যথার্থ সাম্যবাদী; যে সক্রিয়ভাবে সমোচ্চশীলতার নীতি অনুসরণ করে থাকে। জল সমোচ্চশীল বলেই তার মহা আধারটি 'সমুদ্র' পদবাচ্য, যে 'সমুদ্র' শব্দটি একই উন্দ ক্রিয়া থেকে জাত হয়েছে। এই সেই কারণ, যেকারণে পুরাণাদি গ্রন্থে জনসাধারণ বোঝাতে 'জল' শব্দটিও ব্যবহৃত হয়েছে। মোট কথা, 'সুন্দর' শব্দের প্রকৃত অর্থ হল ( পরিপার্শ্বের সঙ্গে ) সুসামঞ্জস্য সাধন করে যে ।
বাহ্যিক দৃষ্টিকোণ ছেড়ে সামাজিক সম্পর্কের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে দেখা যায়, সুন্দরী (সু-উন্দ-র-ঈ) সেই নারী, যিনি তাঁর চারপাশের মানুষের মনকে আর্দ্র করে আপন সমানতার বোধ দান করেন। তার মানর আমার মা/মাসিমা/জ্যাঠাইমা/ঠাকুমা/দিদিমারা যেমন আমাদের মনের আশ্রয় হয়ে ওঠেন, মনে হয় যেন তাঁর কাছে গিয়ে নিশ্চিন্তে সব কথা বলা যায়, তিনি আমাদের মনকে আর্দ্র করে দেন, তিনি আমাদের সমান এই বোধ দান করেন, সেই জন্যই তাঁরা সুন্দরী। বাংলাভাষী বহু মা-মাসিমাকে দেখা যায় রিকশয় উঠে, তাঁর সঙ্গে রিকশাওলার উচ্চনীচ অবস্হানের ভেদ অমান্য করে, তিনি রিকশওলার সঙ্গে গল্প জুড়ে দেন এবং অচিরে রিকশওলার পরিবারের সঙ্গে আপন পরিবারের সুখদুঃখের কথার লেনদেন করে থাকেন। যে-নর বা নারী তাঁর পারিপার্শ্বিকের প্রত্যেকটি সত্তার কাছে এই রকম 'আপনার সমান জন' বা আপনার জন হয়ে ওঠেন, সর্বতোভাবে নির্ভরযোগ্য এবং পারিপার্শিকের আত্মার সমান বলে প্রতীয়মান হন, তাঁরা প্রত্যেকেই সুন্দর বা সুন্দরী। বাংলাভাষা সেরকম সত্তাকেই 'সুন্দর' বা 'সুন্দরী' নাম দিয়েছে। অর্থাৎ সুন্দর বা সুন্দরী শব্দের অন্তর্নিহিত অর্থ হল, 'যিনি সবচেয়ে ভালভাবে পারিপার্শ্বিক সত্তাদের সঙ্গে আপন সামঞ্জস্যসাধন করেন', নিজেকে কখনই বিশেষ, স্পেশাল, আলাদা, বিচ্ছিন্ন, স্বতন্ত্র বলে মনে করেন না, বা তদ্রূপ অভিমান নিয়ে থাকেন না । অর্থাৎ, 'সুন্দর' সত্তার অন্যের সঙ্গে সমান হওয়ার প্রবণতা থাকে, কখনই স্বাতন্ত্র্যের স্বাভিমান থাকে না।
তবে সামঞ্জস্যমূলক সত্তা মাত্রেই দেখতেও বিউটিফুল হয়, কিংবা বিপরীতভাবে বললে, বিউটিফুল সত্তা মাত্রেই আসলে তার ভিতরে কোনো না কোনো প্রকার সামঞ্জস্য বিধান করে রাখা থাকে; তাই সে দেখতে বিউটিফুল হয়।বাহ্যপ্রকৃতির সৃষ্টি থেকে শুরু করে মানুষের হাতে সৃষ্ট শিল্প, সাহিত্য, ভাস্কর্য, নৃত্য, গীত, বিজ্ঞান, রন্ধন এমনকি বস্ত্র-পরিধানের কলাকৌশল পর্যন্ত সকল ক্ষেত্রেই একথা সর্বৈব সত্য ।ব্যাপারটি আমি আমার 'সাম্য থেকে সামঞ্জস্যে: সুন্দরসমাজ' নিবন্ধে ( যা প্রকাশিত হয়েছে 'অপর' পত্রিকার সপ্তদশ সংখ্যায়) বিস্তারিত ভাবে ব্যাখ্যা করেছি। এখানে তার পুনরাবৃত্তি অবান্তর। এখানে
কেবল সামাজিক সম্পর্কের সেই কথায় আমি যাব, 
যার থেকে বোঝা যায়, সুন্দর মানুষ বলতে ঠিক কী বোঝায়।
উপরোক্ত তথ্য অনুসারে সেই মানুষই সুন্দর মানুষ, যিনি তাঁর চার পাশের মানুষকে আপনার সমানতার বোধ দান করেন; যাঁর সংস্পর্শে এলে বুঝতে অসুবিধে হয় না, তাঁর সঙ্গে আমার উচ্চনীচ ভেদ নেই, যিনি ও আমি সমান। অন্য মানুষের জ্ঞানসম্পদ, ধনসম্পদ, বয়স কোনো কিছুই সেই মানুষের ব্যবহারে দাগ কাটে না। তাঁর বিচারে সব মানুষের আত্মাই সমান, তিনি নিজে সেই আত্মার সমতলে বিরাজ করেন এবং প্রত্যেকের সঙ্গে সেই আত্মার সমতলে বিরাজ করে অনুরূপ ব্যবহারই করে থাকেন। কারও সঙ্গেই যেন তাঁর কোনো ভেদ বা স্বাতন্ত্র্য নেই। এমনই এক মানুষ শ্রী সুবিমল বসাক। তাঁর স্বভাব প্রথম আলাপের পর থেকেই জানতাম। কিন্তু সেই স্বভাবের নাম কী হবে জানতাম না। 'বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ'-এর কাজ করতে গিয়ে 'সুন্দর' শব্দের মানে বুঝতে পারার পর এই রকম স্বভাবের সব মানুষকেই আমি 'সুন্দর মানুষ' বলে চিহ্ণিত করতে পেরেছি।
আধুনিকতাবাদী, অ্যাকাডেমিশিয়ান, প্রগতিপন্হি, কমিউনিস্ট-সাম্যবাদী, মৌলবাদী, হাংরি, উগ্রপন্হী... বহু রকম মানুষই আমরা চারিদিকে দেখতে পাই; এবং তাঁদের নেতৃস্হানীয়রা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অত্যন্ত স্বাতন্ত্র্যাভিমানী।স্বাতন্ত্র্যের অভিমানের মধ্যে সকলের থাকে বিশেষ হওয়ার, পৃথক হওয়ার প্রবণতা থাকে। তথাকথিত সাম্যবাদীদের মধ্যে তো স্বাতন্ত্র্যের অভিমান সবচেয়ে বেশি, যদিও স্বাতন্ত্র্য সাধারণভাবে বিশেষবাদী বা অসাম্যবাদী। বিপরীতে দেখা যায়, গ্রামবাংলার মানুষের মধ্যে, তথাকথিত ধর্মভিরু সাধারণ মানুষদের মধ্যে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের অভিমান সবচেয়ে কম। তাঁদের ভিতরে সকলের থেকে পৃথক বা আলাদা হয়ে থাকার কোনো প্রবণতা দেখা যায় না, বিপরীতে মিলে-জুলে থাকার প্রবণতা দেখা যায়। বাংলা ভাষার শব্দার্থতত্বের বিচারে এরকম মানুষদেরই 'সুন্দর' মানুষ বলতে হয়। সেই হিসেবে শ্রী সুবিমল বসাকও সুন্দর মানুষ।
১৯৯৬ সালে তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে। বিগতকালের হাংরি আন্দোলনের এক বিদগ্ধ আত্মারূপেই আমি তাঁকে চিনেছিলাম। একালের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যাবাদী সমাজে সকল সামাজিক সত্তার ও প্রতিষ্ঠানাদির যেমন কেন্দ্র ও প্রান্ত হয়ে থাকে, হাংরি আন্দোলনেও সেইরূপ কেন্দ্র-প্রান্ত ব্যাপার ছিল। কেন্দ্রে যখন মলয় রায়চৌধুরী সগৌরবে বিরাজিত ছিলেন, তখন প্রান্তে ছিলেন সুবিমল বসাক। কালধর্ম তাঁকে যে-কলঙ্ক বা গৌরব দিয়েছিল, তা সবই তখন মলিন হয়ে এসেছিল। তাঁর স্বভাবের মধ্যে সেসবের রং-রূপ, তেজ-ছটা আমার চোখে খুব একটা পড়েনি। যেটি পড়েছিল, তা হল তাঁর নিষ্কলুষ আত্মার দীপ্তি। প্রথম আলাপেই বুঝেছিলাম, এই মানুষটির সঙ্গে নির্বিবাদে ঘর করা চলে।
কলকাতার বাংলা সাহিত্যের জগতে আমার অনুপ্রবেশ ঘটে ১৯৯৫ সালে। ১৯৯৭-৯৮ সালের মধ্যেই আমি টের পেয়ে যাই, এই জগৎ অত্যন্ত কলুষিত হয়ে গেছে। ভাল সাহিত্যিক তো পরের ব্যাপার, আগে তো ভাল মানুষের সাক্ষাৎ পেতে হবে। এখানে যে ভাল মানুষের দেখা মেলা অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে! কার্যত আজকের কলকাতায় বঙ্গসাহিত্যের সারস্বত ব্রহ্মলোকে ভালমানুষের দেখা পাওয়া ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠেছে। যাঁরা মানিষ হিসেবেই কলুষিত, তাঁরা ভাল সাহিত্যিক হবেন, এমন আশা করা খুবই ত্রুটিপূর্ণ এবং দুরাশা মাত্র। তারই মাঝে যে আমি দু'চারজনকে ভালো মানুষ রূপে পাই, তাঁদেরই একজন শ্রী সুবিমল বসাক। ২০০০ সাল থেকে আমি সেমিনার, সাহিত্যসভা ইত্যাদিতে যাতায়াত বন্ধ করে দিই এবং অনেকের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে দিয়ে একান্তে নিজের কাজ করতে থাকি। সেই একান্ত সময়েও যাঁদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক কমবেশি অক্ষুণ্ণ থাকে, শ্রী সুবিমল বসাক তাঁদের একজন। তাঁর সান্নিধ্য আমার খুবই ভাল লাগত। তাঁর ভালমানিষির গন্ধ মনেপ্রাণে মাখামাখি হয়ে যেত। মনে পড়ত সৈয়দ মুজতবা আলীর সেই অমোঘ বাণী --- 'কয়লাওলার সাথে দোস্তি, ময়লা হতে রেহাই নাই/ আতরওলার বাক্স বন্ধ, দিল খুশ তবু পাই খুশবাই।' শ্রী সুবিমল বসাকের সাহিত্যসৃষ্টি নিয়ে আমার কিছু বলার নেই। কেননা, তাঁর সাহিত্য আমার মস্তিষ্কের স্বভাবের সঙ্গে খাপ খায়নি বলে তা আমার উপভোগ্য হয়নি। অতএব, যা আমি ভাল করে উপভোগ করিনি, তা রসাল ও সুস্বাদু কি না, বলদায়ক কি না, উপাদেয় কি না, তা নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে আমি পারব না। কিন্তু মানুষটি যে আমার খুবই আপনজন রূপে গৃহীত হয়েছিলেন, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। তাঁকে আমি 'সুন্দর মানুষ' বলেই চিনেছিলাম, চিনেছি, ভালবেসেছি।


ছিটেফোঁটা পত্রিকার বইমেলা ২০১০ সুবিমল বসাক সম্বর্ধনা সংখ্যা থেকে পুনঃপ্রকাশিত



সুবিমল বসাকের হাবিজাবি--- ২১শে ফেব্রুয়ারি ও পাপের চেহারা

ফালগুনী রায় লিখিত

২১শে ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষা আন্দোলনে শহিদেরা সুবিমল বসাকের মতই প্যান্ট-শার্ট বা পাজামা-পাঞ্জাবি পরে ছিলেন, বাংলা ভাষার জন্যে নিহত না হলেও সুবিমল শহিদ হয়েছিলেন বাঙাল ভাষার জন্যে -- অর্থাৎ মসী, অসি অপেক্ষাও শক্তিশালী এই প্রবচনের সূত্র ধরে বলা যায় কলকাতার অ্যাকাডেমিক অধ্যাপক বা আধুনিক কবি কেউ-কেউ বাড়িতে যারা মা'র সঙ্গে বাঙাল ভাষায় এবং কলেজে কফিহাউসে খালাসিটোলায় বা বেশ্যার সঙ্গে ক্যালকেশিয়ান ডায়ালেক্টে কথা বলেন --- তাঁরা সুবিমলের ভাষারীতিকে প্রচণ্ড আক্রমণ করেন--- কিন্তু ২১শে ফেব্রুয়ারির শহিদরা যেমন একই সঙ্গে শ্রদ্ধেয় সেইমত সুবিমল বসাকও শিক্ষিত কবি-সাহিত্যিকদের উপহাস-গালাগালের গ্লোরিকে ম্লান করে দিয়ে একই ভাষারীতিতে লিখে চলেছেন (১৯৬৪ থেকে)--- লিখে চলবেন।
সুবিমল গদ্য লেখেন এবং কবিতাও --- সুবিমল রবীন্দ্রনাথের মত দাড়ি রাখেন না কিন্তু টাইপমেশিনের সাহায্যে অই ভদ্রলোকের একটা প্রতিকৃতি তৈরি করেছিলেন ছাত্রাবস্হায়--- দেখেছিলুম। সুবিমল রবিঠাকুরের মত গান বা নাটক লেখেননি কোনোদিন, সো হোয়াট ? রবীন্দ্রনাথ না থাকলে সুবিমল লিখতেন কি ? বিশেষত বাঙাল ভাষায়, উপরন্তু যখন দু'বাংলাকে কেন্দ্র করে পাবলিশাররা তাদের পড়ে যাওয়া মার্কেটকে পুনরায় তোলবার চেষ্টা করছে, তখন লক্ষ্য করে দেখুন, সুবিমলের 'বাংলাদেশ' নামে বাঙাল ভাষায় লেখা লিফলেটটিতে কত কম বঙ্গবন্ধু বা বাংলা-দেশ-এর রেফারেন্স।

আরশির ওই পারে ফুটছে শয়তানের চ্যারা
ফিরে-ফিরে প্রতিশোধ লিতে তেইড়্যা আহে
আমার উল্টাহান'ই আমি নিত্যি দেহি আরশিতে

---মাইকেল মধুসূদন দত্ত, যিনি বাঙালি খ্রিষ্টান ছিলেন, তিনি রাবণের ভেতর দেখতে পেয়েছিলেন --- আপন আত্মার ছায়া --- অনুরূপভাবেই সুবিমল ভগবান-বন্দনা করেননি--- শয়তানের ভেতর দেখেছেন নিজস্ব প্রতিবিম্ব--- কিন্তু এর ফলে যদি কেউ বলে, আর দেখতে হবে না --- ও শালা নিশ্চয় মধুসূদন দ্বারা প্রভাবিত, তখন ত্রাহি মধুসূদন ডাক ছাড়া গত্যন্তর আছে কি ? উপনিষদেও বলা হয়েছিল তিনি আছেন --- রবীন্দ্রনাথও বুঝে ছিলেন ব্যাপারটা--- রবীন্দ্রনাথও কি উপনিষদের চর্বিতচর্বণ ? ব্যাপারটা বলতে হল এই কারণে যে আধুনিক গদ্য-পদ্য'র আন্দোলন-এ (সত্য গুহ লিখিত) পট করে লিখে দেয়া হয়--- অমুক-অমুক কবিরা তমুক-তমুক কবিদের চর্বিত চর্বণ করে কবিতা লিখে চলেছেন। কবিতা লেখা ব্যাপারটা নোট মুখস্হ করে এম.এ. ডিগ্রি পাওয়ার মত সহজ নাকি, যে আশুবাবু গোপালবাবু সুকুমারবাবু ইত্যাদির থিওরি-থিসিসের চর্বিত চর্বণ করলেই বভিষ্যতে অধ্যাপক হওয়া বা হায়ার সেকেণ্ডারি স্কুলে বাংলা পড়ানো যাবে।
সুকুমার টের পেয়েছেন--- ব্যর্থতা নিয়া থাকায়ও কারু-কারু সার্থকতা... হেজেহুইতে ট্যার পাই --- কতো-কতো ব্যাপারে ম্যায়ালোকেরে কাৎ কইরা ফেলে বাজারের মাগি। সুবিমল দেখেছেন---

এই শহরের মাগিদের কোঠায় দেহি সরকারি 'নিরোধ'এর বিজ্ঞাপন
কালোবাজারের খয়রাতি দানে না-জানি কতো মন্দির তৈয়ার হইতাসে
এই কিনারে বোমা পরীক্ষা --- আরেক কিনারায় হাসপাতাল

সুবিমল লিখেছেন---

সুখি মানুষেরা একতলা দুইতলা কইরা  উইঠ্যা যায় উপরে
হাতের লাগল থাকে ম্যায়ামানুষ চেনবান্ধা কুত্তা, আদালতের আইন-কানুন

এভাবে সুবিমল যা-কিছু টের পেয়েছেন দেখেছেন সবকিছু লিখে রেখে গ্যাছেন, এমন কি শেষ কবিতার প্রথম দুই লাইন---

ভিয়েৎনামের উপর আমারিকার যুদ্ধনীতি সবরাষ্ট্রের অসমর্থন
অহনই শোওনের তোড়জোড় করতাসো, রাত্র হপায় পড়লো--

এভাবেই বাংলাদেশ আন্দোলনের জোয়ার আসার আগে থেকেই পদ্মাপারের ছেলে সুবিমল দ্যাশের ভাষায় গদ্য লিখে বিদেশে পরিচিত হয়ে গেছে, এখন আমরা যারা খুব বাংলাদেশ নিয়ে লেখালিখি মাতামাতি সভাসমিতি করি, তারা যদি সুবিমল-এর ভাষারীতিকে আক্রমণ করি বা এ-সম্পর্কে উদাসীন থাকি তবে সেটা একটা পাপের পর্যায়ে গিয়ে পড়বে...

( কিন্তু পত্রিকায় প্রকাশিত, ১৯৭১)   

রবিবার, ৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১১

প্রত্নবীজের সন্ধানে

অধ্যাপক অলোক রায় লিখিত

প্রত্যেক বছর পুজোসংখ্যায় কতগুলি উপন্যাস ছাপা হয় তার হিসেব জানা নেই। দশ-বারোটি বাজারি পত্রিকায় সম্ভবত শ'খানেক উপন্যাস বের হয়। এ ছাড়া তথাকথিত ছোট পত্রিকাতেও আজকাল উপন্যাস থাকে বা উপন্যাসোপম গল্প। এত যে লেখা হয়, তার মধ্যে মনে দাগ কাটে এমন উপন্যাস সংখ্যায় নগণ্য। অ্যাকাডেমিক বিচার এখন শিকেয় তোলা থাক, সাধারণ পাঠকের প্রতিক্রিয়ার কথাই বলছি। উপন্যাসের শিল্পরূপ নিত্য পরিবর্তমান। নিটোল পরিপুষ্ট ইচ্ছাপূরণের কাহিনী আজও লেখা হয়। ভোগ্য পণ্যের মত বিজ্ঞাপনের কল্যাণে এ ধরণের গল্প হয়তো জনপ্রিয়ও বটে। তা না হলে বাজারি পত্রিকা এমন উপন্যাস ছাপে কেন ? কিন্তু বাজার দখল করার প্রত্যক্ষ অভিপ্রায় ছাড়াও উপন্যাস লেখা হয় ।তাকে যথার্থ উপন্যাস বলা যাবে কি না তা নিয়েও সংশয় থাকতে পারে। তবু এর দরকার আছে । এমন কিছু কথা বলতে হয়, যা এতদিন কবিতাতেই বলা হয়েছে। কিংবা প্রবন্ধে। এমন উপন্যাসের আধারে পরিবেশ করা হলে আপত্তির কিছু নেঈ। উপন্যাস মিশ্রশিল্প। উপন্যাস খুবই নমনীয় সহজবশ্য শিল্পরূপ। তবে উপন্যাসের অনেক পরিবর্তন সত্বেও তার সঙ্গে বাস্তব অভিজ্ঞতার একটা যোগ অস্বীকার করা যায় না। সমস্যা যদি কিছু থাকে তা হলো বাস্তবের স্বরূপ-সত্য নিয়ে।
সুবিমল বসাকের প্রথম উপন্যাস বা গদ্যন্যাস ছাতামাথা   (১৯৬৫) আমি পড়িনি । দ্বিতীয় উপন্যাস প্রত্নবীজ (১৯৯৬) কয়েক বছর আগে ছাপা হলেও সদ্য আমি পড়বার সুযোগ পেয়েছি। উপন্যাস, কিন্তু আদৌ অবসর-বিনোদনের সামগ্রী নয় । পড়ে চমকে উঠতে হয় । কারও ভালো লাগবে, কারও লাগবে না, এটাই স্বাভাবিক। তবে অগ্রাহ্য করা অসম্ভব। একটা প্রবল আলোড়ন তোলা সম্ভব। অথচ সেভাবে আলোড়ন সৃষ্টি করেনি। এটাই বিস্ময়কর। অথবা বিস্ময়ের কিছু নেই। প্রত্যেক বছর বাংলায় যে একশো-দেড়শো উপন্যাস বেরোচ্ছে, তার নিশ্চয় বিশেষ একজাতের ভোক্তা আছে। তাঁরা প্রত্নবীজ পড়তে উৎসাহ বোধ নাও করতে পারেন। 
ঠিক কার্যকারণ জানি না। তবে একটা আশঙ্কার কথা জানিয়ে রাখি। ছয়ের দশকের গোড়ায় হাংরি জেনারেশন নামে যে বুলেটিন বেরিয়েছিল, এবং তারপর এই নামে ক্ষুধার্ত প্রজন্ম নামে যে-সাহিত্যান্দোন প্রসার লাভ করেছিল, তার স্রষ্টা ছিলেন মলয় রায়চৌধুরী। এই পত্রিকার যে-সংখ্যায় (অষ্টম সংখ্যায়) সুবিমল বসাকের লেখা ছাপাহয়, সেই সংখ্যাটি অশ্লীলতার দায়ে আদালতে অভিযুক্ত হয় (অবশ্য তাঁর লেখার জন্যই এমনটা ঘটেছিল তা নয়)। মলয় রায়চৌধুরীর জেব্রা (১, ২) পত্রিকায়  (১৯৬৫, ১৯৬৭) সুবিমল বসাকের গেরিলা আক্রোশ আর জাবড়া ছাপা হয়। সুবিমল বসাক ''নিয়ন্ত্রিত" আর একটি পত্রিকার কথা জানা যাচ্ছে-- প্রতিদ্বন্দ্বী, তাতে ছাপা হয় সুবিমল বসাকের বেশ কয়েকটি গদ্যরচনা-- যেমন, প্রতিবিম্ব, আগ্রাসী অপকর্ম, মেরামতহীন ফাটল  প্রত্নবীজ বইটির শেষে মলয় রায়চৌধুরীর সংযোজন সেই পুরনো যোগসূত্রের কথা মনে করিয়ে দিল। 'ব্রিটিশ রাজত্বের কুষ্ঠে বাঙালির পচনশীলতা ও অবক্ষয়' বা বাঙালির মধ্যে লভ্য 'ব্রিটিশ রাজত্যের ফেলে যাওয়া মূল্যবোধ' ইত্যাদি প্রসঙ্গ উপন্যাসব্যাখ্যায় কতটা সাহায্য করে, সে বিষয়ে সংশয় আছে।মলয় রায়চৌধুরী দাবি করেছেন প্রত্নবীজ হলো 'সাবঅলটার্ন উপন্যাস'। হয়তো তাই। নিম্নবর্গের মানুষের ইতিহাসের ধারণা পেয়েছি গ্রামশির রচনায়। ভারতবর্ষেও অধুনা সাবঅলটার্ন ইতিহাস লেখা হচ্ছে, লিখছেন রণজিৎ গুহ, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, গৌতম ভদ্র  ও অনেকে। কিন্তু সাবঅলটার্ন উপন্যাস? ফরাসি ঐতিহাসিক ইমানুয়েল ল্য রোয়া লাদুরীর 'মঁতাইউ'কে নিয়ে লেখা বইটি উপন্যাস নয়, উপন্যাসের আকর-গ্রন্থ বলা যেতে পারে। একালে আমরা যাকে 'আনাল' (Annales) বলছি, তার মধ্যে ইতিহাসের বড় সময় থেকে ছোট সময়ে নেমে আসার প্রয়াস মেলে। এইখানে ঐতিহাসিকের সঙ্গে সাংবাদিকের মিল ও অমিল।অশীন দাশগুপ্তের  ভাষায় "ঐতিহাসিক অতীতকালের সাংবাদিক এবং সাংবাদিক বর্তমানের ঐতিহাসিক"। সুবিমল বর্তমানের ঐতিহাসিক । তাঁর লেখার বিষয় অচিরকালের মধ্যে ইতিহাসে পরিণত হবে, হয়তো ইতিমধ্যেই হয়েছে। এদিক থেকে তাঁর রচনা 'আনাল-ধর্মী' হতে পারে, কিন্তু হাংরি জেনারেশন  বা সাবঅলটার্ন সাহিত্যের প্রসঙ্গ প্রত্নবীজের আলোচনায় না আনাই ভালো। মলয় রায়চৌধুরীর সংযোজন ( "সুবিমল বসাক অমন অঢেল যুক্তিহীনতাকে পাঠকের সোপর্দ করেছেন"), এবং প্রচ্ছদের লেখক পরিচয় এদিক থেকে কিছুটা বিভ্রান্তিকর ("সাবঅলটার্ন এই উপন্যাস বস্তুত শ্রেণী-সংগ্রামের চেতনায় উজ্জীবিত")।
কাহিনীর সূচনায় লেখক স্হান-কাল-পাত্রের নির্দেশ দিয়েছেন -- "বাংলার বাইরে গড়ে ওঠে বাঙালিদের নিজস্ব ঘরানার এলাকা। এই সব বাঙালিরা মিশে গেছেন বিভিন্ন রাজ্যের ভূমিপুত্রের সাথা। ভাষা, সংস্কৃতি সব গ্রাস করে মিলিয়ে গেছেন তাদের মাঝে। সে জীবন, যে বাংলাভাষা, সে সংস্কৃতি বাঙালির, তবু তা অন্যরকম।... তাদের যে কী ইতিহাস তা কেউ জানে না। এই রচনাটি সেই সব মিথের গল্প।" কাহিনী তাই ইতিহাসও বটে। অবশ্য এখানে ভুল বোঝার একটু সম্ভাবনা আছে। বিহারের রাজধানির কোনো এক মহল্লায় বসবাসকারী বাঙালিকে নিয়ে উপন্যাস লেখা সুবিমল বসাকের উদ্দেশ্য ছিল না। প্রবাসী বাঙালি মধুবাবুর আট-ন' বছরের ছেলে, বাঙালি মাইজি 'খোকা কে মাই', আর খোকার ঠাইনি কেন্দ্রে আছে বটে, তাদের চোখ দিয়েই হয়তো লেখক দেখেছেন প্রতিবেশী ভগযোগিনী আর তার স্বামী হালওয়াইয়ের দোকানদার রামখেলাওনকে। সেই সঙ্গে এসেছে দুলহানিয়া বাতাসিয়া, কচরি-ফুলৌরি দোকানের তেতরি, মোদির দোকানের নগীনা, কাজের মেয়ে সুগিয়ার মা, বিপৎ গোপ, ফেকন চামার, খোটন আর বুলকন, বুধনি ডাইনি। "চারোওর মহল্লার গোয়ালা, কাহার, কুর্মি, কুমহার, ধানুক, দোসাদ জাতের ভিড়।" এর মধ্যে মুনেশ্বরবাবু, নাগেশ্বর পরসাদ, বিন্ধেশ্বরী সিং, রামাধারীর মতো অর্থবান মানুষ দুচারজন আছেন, কিন্তু প্রত্নবীজ  যেমন প্রবাসী বাঙালীর কাহিনী নয়, তেমনি লালা-কায়েতদেরও কাহিনী নয়।
মলয় রায়চৌধুরী জানিয়েছেন, "পাটনা শহরের কয়েকটি পাড়াকে এই সাবঅলটার্ন শ্রেণী দিয়েছেন তাঁদের বহুল প্রচারিত খ্যাতি। ঐ পাড়াগুলির মধ্যে থেকে সুবিমল বসাক বেছে নিয়েছেন লোদিপুর নামের কুখ্যাত লুমপেন প্রলেতারিয়েত পাড়াটি।" এই পাড়ায় ভূমির সঙ্গে সম্পর্কহীন কাহার কোয়রি ডোম চামার দুসাধ মুসাহার হাজাম ধোবি বড়হি ক্রমশ একাকার । কিন্তু যেসব মানুষগুলির দেখা মিলল উপন্যাসে, তারা কেউ কুখ্যাত লুমপেন প্রলেতারিয়েত বলে মনে হয় না। বিপৎ গোপ ও তার চ্যালাচামুণ্ডাদের চোর-ডাকাতেরা ভয় পেতে পারে, কিন্তু দাঙ্গা হাঙ্গামা করে বেড়ানো তাদের পেশা নয়। অন্যদিকে এরা প্রায় কেউই নির্বিত্ত সহায়সম্বলহীন নয় । এদের নিজেদের একটা সমাজ আছে ( মুসহর শুধু অস্পৃশ্য নয়, তার জলের ছিটে লাগলে এদের 'জাত' যাবে)।সেখানে বহুল প্রচারিত প্রথানুগত্যের সামাজিক ও পারিবারিক রীতিনীতির কেউ বিরোধিতা করে বলে মনে হয় না। কাজেই ঠিক বোঝা গেল না কীভাবে "একটি পাড়ার সকলেই আধুনিকতার একাধিক রোগে ভুগছে এবং তার মধ্যেই গড়ে উঠছে বহুমুখী ঐক্যের প্রবণতাগুলি, যেগুলি আধুনিকতাকে ছাপিয়ে বা ডিঙিয়ে একটি নবতর নৈতিকতা ও বৈধতার জন্যে উন্মুখ।"
কেউ-কেউ আজ এমনকথা বলছেন, উপন্যাস মাত্রই ঐতিহাসিক, উপন্যাস মাত্রই আঞ্চলিক।সুবিমল বসাক সচেতনভাবে ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখেবেন বলে উপন্যাস লেখেননি ( তবে 'ইতিহাসের' কথা তাঁর মনে ছিল ) । পরিবর্তমান সমাজে বিশেষ একটি অংশের অনুপুঙ্খ বর্ণনা ইতিহাসের সামগ্রী -- বর্তমানের কাহিনী হলেও তা ইতিহাস। বিশেষত ভাষা ব্যবহারে আঞ্চলিকতাকে যেভাবে কাজে লাগানো হয়েছে, তা বিস্ময়কর। ঢোঁড়াইচরিতমানস-এ সতীনাথকে টীকা-টিপ্পনীর আশ্রয় নিতে হয়েছিল। আলাউদ্দিন আল আজাদের কর্ণফুলি উপন্যাসে চট্টগ্রামের ভাষাব্যবহার চমকপ্রদ লেগেছিল একসময়। কিন্তু সশেষ পর্যন্ত চরিত্রকে ফোটাবার প্রয়োজনেই বিশেষ ভাষা ব্যবহার । তা না হলে অপরিচিত মহল্লা, ততোধিক অপরিচিত মানুষজন, আর তাদের ভাষাকাঠামোতে পাটনাইয়া বুলি প্রয়োগ -- অপরিচয়জনিত বিস্ময়রস সৃষ্টিতে সক্ষম, কিন্তু উপন্যাস হিসেবে স্বতন্ত্র মর্যাদা দাবি করতে অক্ষম। প্রত্নবীজ  নানা কারণে অসামান্যতা দাবি করে, কিন্তু ভুল জায়গায় জোর দিলে উপন্যাসের ভ্রান্তপাঠের সম্ভাবনা বাড়ে। 
অবশ্য সাহিত্যের পাঠ-পাঠান্তর থাকতেই পারে। কাকে বলে যথার্থপাঠ আর কাকে বলে ভ্রান্তপাঠ -- নিঃসংশয়ে কখনই বলা সম্ভব নয়। আমি আমার নিজের মত করে প্রত্নবীজ পড়েছি। আমার প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে আর একজন পাঠকের অমিল হতেই পারে। তবে সুবিমল বসাকের অভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষণশক্তি ও ভাষা ব্যবহারে নৈপুণ্য নিয়ে কোনো প্রশ্নই উঠতে পারে না। কাহিনীর প্রেক্ষিতের সঙ্গে ভূচরিত্রের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে---

 ওদিকে নালা রোড, করবিঘাইয়া, এদিকে মন্দিরি রাজাপুর, মানপুরা, চিৎকোহরা-- এলাকা জুড়ে সার-সার মাথা, তালগাছের। ফাঁকা মাঠে দাঁড়ালে তাড়বন্না যেন মেঘের মতো আকাশে লেপ্টে।
লোদিপুর গয়া রোড দোকানে দোকানে ঢিবরি আর পঞ্চলাইটের রোশনী। ফেরার পথে--- পটনা-গয়া রোডে গঙগা আস্নান যাত্রিদের পায়ের ্অহত আওয়াজ শোনা যায়। এদিকে মিশনারি স্কুলের উল্টোদিকের বস্তি থেকে লোদিপুর, এ.আর.পি., ব্যাঙ্ক রোড, তিমোহানি, বাঁশঘাট, মন্দিরি -- যত সব ছেলে-জওয়ান লোক আছে, রাম নামে ছড়াছড়ি।
চারোওর লোকজন, পহেলবান, মুসাফির। দুদিকে রিক্সা, বৈলগাড়ি, সাইকেল, টমটম, ফিটন। আনা-জানা বন্ধ।
পাক্কি সড়কের কিনারে, মিশনারি ইস্কুলের পাশেই, বিপৎ গোপের ভাড়ি খাটাল। রাস্তার ধারে ইঁটের দিওয়ার, ভেতরে খাটাল। বাঁশের বাল্লায় খাড়া করা ছাউনি -- পুয়াল-খড়ের ওপরে খপরৈল --- অনেকখানি এলাকা জুড়ে। বিপৎ গোপের অখাড়া পটনাভর মশহুর।

আবার ভৌগলিক অবস্হানের সঙ্গে মিলিয়ে রচিত হয় চরিত্রের মুখের ভাষা। ভগযোগিনী বা রামখেলাওন, সুগিয়ার মা বা বিপৎ গোপ যে-ভাষায় কথা বলে, তাকে হিন্দি ভাষার নিদর্শন বললে ভুল হবে।'বাংলা ভাষাকাঠামোতে পাটনাইয়া বুলি প্রয়োগে' বাংলা কথাসাহিত্যে অভিনব সামগ্রী। আসলে হিন্দিভাষী মহল্লার মানুষজন ঠিক যে-ভাষায় কথা বলে, আগাগোড়া  তার ব্যবহার কাহিনীর পক্ষে গুরুভার হয়ে উঠত। 'খোকা-কে-মাই' হিন্দি বাংলা মিশ্র ভাষায় কথা বলবে সেটাই স্বাভাবিক, কিন্তু ভগযোগিনীও অনেক সময়ে সেই ভাষা ব্যবহার করে -- 

হ্যাঁ রে, কাল রাতে কান্না করছিলি কাহে?
আমাকে বহুত পিটেছিল--
পিটেছিল ? কাহে ? নিশা-ভাঙ করেছিল নাকি?
নেহি খোকা-কে মাই। ওকরে আদত এহি। ঐসে ঐসে পিটেছিল--
সে কি ? তোর লাগেনি ? খুব চেল্লামিল্লি করছিলি যে --
উ তো ঐ সেহি রোনা করেছিলাম।

মাঝে-মাঝে মিশ্র ভাষার বাংলা রূপান্তর [মৌগিঅনকে সামনে সরম কৌচিকা -- (মেয়েদের সামনে আবার লজ্জা কিসের!) কা বাত হ্যায় ? ব্যাপার কি ? ববন্ডর হো গয়া -- (সাংঘাতিক ব্যাপার), কখনও বন্ধনীর মধ্যে অর্থনির্দেশ (দিবালি -- দেউলিয়া)] বর্ণনা অংশে সাধারণত বাঙালির মুখের ভাষাই ব্যবহৃত হয়েছে, হয়তো মাঝে-মাঝে উদ্ধৃতিচিহ্ণের মধ্যে হিন্দি দুচারটি কথা--

যেই যায়, পণ্ডিতজি তার মাথায় লাগিয়ে দেয় ফাগের টিকা। তারপর গোটা মুখমণ্ডলে, ক্রমশ হাতে-পায়ে, পেটে। আবির মাখালে নাকি 'মাতামৈয়া' ( মানে মা শেতলা, অর্থাৎ বসন্ত)হয় না।
ঘাস-নেওয়ারির তৈরি হোলিকা, চারিদিক ঘিরে জড়ো করা তুম্বাকার গোইঠা, কাঠ-বাঁশ, টায়ার, কাগজ, শুকনো পাতা -- সব কিছুতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে বাচ্চা-জোয়ানরা বসে থাকে দূরে। আগুনের লকলকে আলো, ফটাফট আওয়াজ আর সেই সঙ্গে কালো ধোঁয়া মিশে যায় আকাশে বাতাসে। পোড়া গন্ধে ভরে যায় পরিবেশ। বাচ্চা-জোয়ানরা শিকে কাঁচা আলু একটা-তিনটে-পাঁচটা-সাতটা গেঁথে ছুঁড়ে ফেলে আগুনে । দহন শেষে ছাই উড়িয়ে শিক খুঁজে-বেছে বার করে আনো পোড়া আলু, হাতে-হাতে বিলি হয় পরসাদি।

প্রত্নবীজ-এ প্রচলিত উপন্যাসের নিটোল কাহিনীবৃত্ত প্রত্যাশা করে লাভ নেই। সুবিমল বর্তমানের ঐতিহাসিক, তাই তাঁর রচনায় কিছুটা সাংবাদিকতার ধরন এসেছে। পনেরোটি পরিচ্ছেদে মহল্লের নানা ধরনের মানুষ এসেছে। কারও জীবনের আদ্যন্ত কাহিনী বর্ণন লেখকের উদ্দেশ্য নয়। হয়তো ন'বছরের খোকার চোখ দিয়ে দেখা হয়েছে বলে তাকে কাহিনীর যোগসূত্র বলা যেতে পারে। কিন্তু সব জায়গায় সেও নেই, বা তার চোখ দিয়ে সব কিছু দেখাও হয়নি। বুধনি কিংবা ফেকন কিংবা বুলকনকে নিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছোটগল্প রচনা সম্ভব ছিল। কিন্তু সুবিমল বসাকের ঝোঁক ব্যক্তিচরিত্র নয়। অশীন দাশগুপ্ত  যাকে বলেন ব্যক্তিসময়, তার ব্যবহার সেভাবে ঘটে না। বড়সময়ের উল্লেখ দুএক জায়গায় আছে, কিন্তু কালনির্দেশ কাহিনীকারের উদ্দেশ্য নয় --  "এক জমানা ছিল, যখন অংগ্রেজ সরকারের খুফিয়াসিআইডিরা তার ওপর নজরদারি করত। কত লাখো-লাখো নওজয়ান তাঁর গানা শুনে সুরাজি দলে ভিড়ে্ছে, ভারি রকম চাঁদা দিত সুরাজি দলে।"  ছোটসময়  নিয়েই প্রত্নবীজ-এর কথাকারের কারবার । তাই 'তাড়ি নয় বৈশাখি', বাতাসিয়ার শাদির প্রস্তুতি থেকে গৌনা, মাঝে-মাঝে রঙিন ফেরিওয়ালা, হালওয়াইয়ের নজারা, তেল মালিশ, অখাড়াবাজি, মাদারিঅলার করিশমা -- এই সব নিয়ে মহল্লার বিচ্ছিন্ন চিত্রের মধ্য দিয়েই পূর্ণ চিত্র ফুটে ওঠে। উৎসব-অনুষ্ঠান বর্ণনার মধ্যে কাহিনীর ভাবৈক্য সন্ধান করলে একেবারে ভুল হবে না।

বছরভর কত তোহার-পরব-- ছট, কার্তিক পূর্ণমাসি, দশহরা, দিওয়ালি, পুষ-সংক্রান্তি, হোলি, তীজ, কর্মা, বৈশাখি, গোবর্ধনপুজা, চিত্রগুপ্তপুজা -- এছাড়েও সৎনারানজীর কথা, অখণ্ড সংকীর্তন । কিন্তু হোলি আর দিওয়ালির মতো এমন জমকালো পরব নেই। দশহরাও তেমন করে মানায় না। হোলি হচ্ছে বসন্ত ঋতুর পরব-- জওয়ানি ও মিলনের উৎসব; দিওয়ালি হলো রোশনাইয়ের, লছমি-পুজন। গোবর্ধনপুজা  -- গোয়ালা আহিররা করে, বিপৎ গোপের অখাড়ায় খুব ধুমধাম করে উৎসব মানায়, পুজাপাঠ, গানা-ঢোলক, কুস্তি-দাঁও-পেঁচের নুমাইশ চলে। চিত্রগুপ্তপুজা -- দিওয়ালির পর স্রেফ লালা-কায়েতরা। এই দিনে লালারা কোনো লিখা-পঢ়ির কাম করে না, কলম ছোঁয় না। লাখ জরুরত থাকলেও এক অক্ষরও লিখবে না-- মানিঅর্ডার, কর্জ-পর্চা, ডাক্তারি নুস্খা--- কোথাও না। ছট পরব চলে মাহিনা ভর; সুরজ দেওতার পূজা, গঙ্গার কিনারে অস্হায়ী ঝোড়ি। খুব নিয়ম আচার।

হোলি আর দিওয়ালির কাহিনীরূপ সুসম্পূর্ণ। বিহারিদের জীবনচিত্র অবলম্বনে সাংবাদিক অসামান্য সংবাদ-বিচিত্রা রচনা করতে পারেন। কিন্তু সুবিমল বসাক সাহিত্যিক --- তাই নিরুদ্দেশ সংবাদ বা চমক সৃষ্টির প্রয়োজন খাসখবর রচনা তাঁর উদ্দেশ্য নয়। তিনি অঞ্চলকে অবলম্বন করে অঞ্চলের মানুষ, অঞ্চলের মানুষকে অবলম্বন করে হাশাআকাঙ্খাময় জীবনের গভীর সত্যকে ধরতে চান।
ভূমিপুত্রদের সঙ্গে বহিরাগত বাঙালিদের মিলে-মিশে থাকারই কথা। মহল্লায় কয়েকঘর বাঙালির কথা বলা হয়েছে --- খোকা, খোকা-কে-মাই, 'পঢ়ালিখা আদমি খোকার বাবা, ঠাইনি, মিউনিসিপালিটির ট্যাক্স কালেক্টর চিন্তাহরণবাবু, বাঙালি মাস্টারিনিজি আর তার মর্দ। এরা পরিপার্শ্বের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছে নিজেদের। অবশ্য দূরত্ব থেকেই যায়। আর এই দূরদৃষ্টি থেকে প্রত্নবীজ লেখা। মাস্টারিনিজির মর্দের কয়েকদিন তবিয়েত আচ্ছানেই, ঘরেই বসে আছে, "মাথা টনটনায়, পায়ের তলহটি গরম।" কতক্ষণ আর কিতাব পড়া যায়। তাই "মাঝে-মাঝে খিড়কি দিয়ে আসমান দেখে, পঞ্ছি দেখে, বাদল দেখে, দুরে মকান, মাটির বাড়ি, খাপরার ছাদ, আঙ্গন-ওসারা দেখে।" দু-মঞ্জিলার ওপর থেকে দেখে রামখেলাওণকে তেলমালিশ করে ভগযোগিনী ।--- "মাস্টারিনিজির মর্দের নজর ধুঁধলে যায়, কপালে জোর দরদ মহসুস হয়। চুপচাপ কুর্সিতে শরীর এলিয়ে শুয়ে থাকে। হাত থেকে কখন যে কিভাবে পড়ে যায়, পতা তক চলে না তার।" প্রত্নবীজ  পড়ার প্রতিক্রিয়া আমারও অনেকটা এই রকমই --- পিছনে ফেলে আসা এক জীবন, তার দিকে সতৃষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা, সেখানে আর ফিরে যাওয়া যাবে না। খোকা তো চিরকাল ন'বছর বয়সেই থাকবে না!
(কালিমাটি পত্রিকা, ফেব্রুয়ারি, ২০০১)