সুবিমল বসাক ও তাঁর লেখালিখি : তন্ময় ভট্টাচার্য
তাঁর লেখা অনেকেই পড়েনি। কিন্তু যারা পড়েছে, ভুলতে পারেনি। তিনি
সুবিমল বসাক। বাংলা সাহিত্যের ব্যাতিক্রমী গদ্যকারদের প্রথম সারিতেই উঠে
আসা উচিৎ তাঁর নাম। অথচ, প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা যথেষ্ট হলেও, মূলত প্রচারের
অভাব, দুষ্প্রাপ্যতা ও প্রকাশকের প্রকাশকের উদ্যোগহীনতার কারণে তাঁর
বেশিরভাগ বই-ই গরিষ্ঠ সংখ্যক পাঠকের অপঠিত থেকে গেছে আজ পর্যন্ত। ভবিষ্যতের
জন্য বইগুলি বাঁচিয়ে রাখা একান্ত প্রয়োজন; নইলে বাংলা সাহিত্যের কিছু
দুর্মূল্য রত্ন আড়ালে চলে যাবে চিরদিনের জন্য…
(১)
১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৩৯ সালে বিহারের পাটনায় জন্মগ্রহণ করেন সুবিমল
বসাক। কিন্তু আদতে তাঁর শিকড় পূর্ববঙ্গের ঢাকায়। একটি সাক্ষাৎকারে তিনি
বলেছিলেন – “বাবা যৌবনে ঢাকা ছেড়ে আসেন, কাজের ধান্দায় নানান জায়গায়
ঘুরে শেষে পাটনায় থিতু হন। ভাল কারিগর ছিলেন, উদ্যমী ছিলেন, পরিশ্রমীও
ছিলেন। প্রচুর অর্থ উপার্জনের সঙ্গে সঙ্গে অভিজাত মহলেও একটা আসন গড়ে
তুলেছিলেন। পাটনায় দোতলা বাড়ি নির্মাণ করেন ১৯৩৯ সালে, আমার জন্মবর্ষে,
কিন্তু গৃহপ্রবেশ করেছিলেন কয়েকবছর পর; কেননা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের
প্রস্তুতিপর্বে জনৈক মিলিটারি অফিসার আমাদের বাড়িতে ঢুকে পড়েন। মা-কে ঢাকা
থেকে নিয়ে আসার পর পাটনার স্থায়ী বাসিন্দা। আমাদের স্বজাতি অন্যান্য
ব্যবসায়ীর তুলনায় আমাদের অবস্থা খুব উন্নত ছিল বলা যায়। পরিবারের
অন্যান্যরা ঢাকায় থাকতেন, যৌথ পরিবারের দরুণ বাবাকে নিয়মিত খরচ পাঠাতে হতো।
আমার মামার বাড়িও ঢাকায়, তখন বিয়ের সম্বন্ধ হতো কাছে পিঠে। পরে অবশ্য এক
মামা আর মেসো খাগড়ায় স্থায়ী বাসিন্দা হন। মামাতো ভাই-বোনেরা খাগড়াই ভাষায়
কথা বলে। ঢাকায় আমরা শেষ যাই পঞ্চাশ সনের কিছু আগে, পাসপোর্ট-ভিসার প্রচলন
হয়নি, তখনও ভারতীয় টাকা চলতো – নোটের বাঁ-দিকে সাদা অংশে ‘গভর্নমেন্ট অফ
পাকিস্থান’ ছাপা থাকতো, ডানদিকে ষষ্ঠ জর্জ। পঞ্চাশের দাঙ্গায় আত্মীয়-স্বজন
সকলেই বাড়ি জমি, স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ফেলে রেখে চলে আসে। রিফ্যুজি
কার্ড হোল্ডার। আমরা অবশ্য সে অর্থে রিফ্যুজি নই, কিন্তু অবস্থা খারাপ ছিল
রিফ্যুজি-আত্মীয়দের চেয়েও…”। তাঁর পিতা ছিলেন গহনার দোকানের মালিক।
যথেষ্ট স্বচ্ছ্বল অবস্থা থাকা সত্ত্বেও, ১৯৬৩ সালে ভারত সরকার কর্তৃক
‘গোল্ড কন্ট্রোল’ আইনের ফলে অনেক ব্যবসায়ীর সঙ্গে তিনিও আর্থিক বিপর্যয়ের
মুখে পড়েন এবং নাইট্রিক অ্যাসিড খেয়ে আত্মহত্যা করেন।
পাটনায় মলয় রায়চৌধুরী, সমীর রায়চৌধুরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও
দেবী রায়ের নেতৃত্বে ১৯৬০ সালে শুরু হয় হাংরি আন্দোলন। বাংলা সাহিত্যের
তথাকথিত সংরক্ষণশীল মানসিকতা ভেঙে নতুন পথের সূচনা করাই ছিল আন্দোলনকারীদের
লক্ষ্য। মলয় রায়চৌধুরীর সঙ্গে আলাপের সুবাদে, পিতার মৃত্যুর পর, ১৯৬৩
সালের শেষের দিকে সুবিমল বসাক যোগ দেন হাংরি আন্দোলনে। তাঁর শক্তিশালী
কবিতা ও গদ্যের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন এবং
সমান্তরালভাবে চক্ষুশূল হন বাংলা সাহিত্যের অধিপতিদের। পাটনা থেকে আগত
সাবঅল্টার্ন শ্রেণীর একজন বাংলা সাহিত্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে – এ তাঁরা সহ্য
করতে পারেননি। সুবিমল বসাক তখন ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ নামের একটি লিটল ম্যাগাজিন
সম্পাদনা করতেন। সেই পত্রিকার এক সংখ্যায় শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের একটি কবিতা
ছিল। ‘দেশ’ পত্রিকার সম্পাদক সাগরময় ঘোষ শক্তি’র ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন,
হাংরি পত্রিকায় লেখা দেয়ার জন্য। ফলে সুবিমল বসাকের ওপর শক্তি
চট্টোপাধ্যায়ের আক্রোশ জন্মায় এবং একদিন কলেজ স্ট্রিট কফি হাউজের নিচে
সুবিমল বসাক’কে দলবল সহ ঘিরে ধরে শক্তি লোহার রড দিয়ে মারতে উদ্যত হন। সে
সময় সেই চত্ত্বরে উপস্থিত ছিলেন দেবী রায়, ত্রিদিব মিত্র, বেলাল চৌধুরী
প্রমুখ। তাঁদের তৎপরতায় ঝামেলা বেশিদূর গড়ায়নি। এ সব ঘটনা এখন কিংবদন্তী।
অশ্লীলতার দায়ে হাংরি জেনারেশনের যে পত্রিকাটি বাজেয়াপ্ত হয়েছিল, তাতে
সকলের সঙ্গে সুবিমল বসাকেরও লেখা ছিল এবং যে এগারোজনের বিরুদ্ধে সাহিত্যে
অবসিনিটির জন্য আদালতে মামলা দাখিল করা হয়, তাঁদের মধ্যে সুবিমল বসাক একজন।
পরবর্তীকালে ১৯৬৫তে আন্দোলন সমাপ্ত হলে আন্দোলনকারীরা পরস্পরের থেকে
অনেকটাই বিচ্ছিন্ন হয়ে যান এবং ব্যক্তিগত লেখালিখির ধারা বজায় রাখেন।
সুবিমল বসাকের প্রথম গ্রন্থ ‘ছাতামাথা’, ১৯৬৫ সালে প্রকাশিত।
তাঁর অন্যান্য বই – হাবিজাবি(১৯৭০), গেরিলা আক্রোশ(১৯৭৪), আত্মার শান্তি
দু’মিনিট(১৯৮৫), অযথা খিটক্যাল(১৯৮৭), বিয়ার গীত ও ঢাকাই ছড়া(১৯৮৭),
কুসংস্কার ১৫৫(১৯৮৭), প্রত্নবীজ(১৯৯৬), ক্যাজুয়াল লিভ(২০০০),
বকবকানি(২০০০), এথি(২০০১), কুট্টি(২০০৩), তিজোরীর ভিতর তিজোরী(২০০৫), গোপন
দস্তাবেজ ও শীততাপ নিয়ন্ত্রিত আত্মা(২০০৭), দুরুক্ষী গলি(২০১১), এখনও কোনো
ব্যবস্থা হয়নি(২০১৪)। এর মধ্যে ‘হাবিজাবি’ ও ‘বকবকানি’ এ দুটি কবিতা সংকলন।
সুবিমল বসাক বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান অনুবাদক। তাঁর অনুদিত
গ্রন্থগুলি হল – প্রতিবেশী জানালা(কবিতা সংকলন, ১৯৭৫), তিসরী কসম(ফণীশ্বর
নাথ রেণু, ১৯৭৬), পঞ্চপরমেশ্বর(প্রেমচন্দের গল্প সংকলন, ১৯৮০), ফণীশ্বর নাথ
রেণু’র শ্রেষ্ঠ গল্প(১৯৮২), দুই সখী(প্রেমচন্দের গল্প সংকলন, ১৯৮৪), জীবন
সার(প্রেমচন্দের প্রবন্ধ, ১৯৮৫), উজ্জয়িনীর রাস্তা(শ্রীকান্ত বার্মার কবিতা
সংকলন, ১৯৮৬), বোবাদের পল্লীতে(জগদীশ চতুর্বেদীর কবিতা সংকলন, ১৯৮৯),
খুবসুরত(খাজা আহমদ আব্বাসের গল্প সংকলন, ১৯৯২), গোমুখ যাত্রা(শীলা শর্মা’র
ভ্রমণকাহিনী, ১৯৯২), মোহন রাকেশ(প্রতিভা অগ্রবাল রচিত জীবনী, ১৯৯৩), হিন্দী
কাহিনী সংগ্রহ(১৯৯৯), আমার তোমার তার কথা(যশপালের উপন্যাস, ২০০১),
যাত্রিক(নীল পদ্মনাভন, ২০০২)।
ওপরে ২০১৫ পর্যন্ত প্রকাশিত বইগুলির নামই উল্লেখ করা হয়েছে।
২০১৬ কলকাতায় বইমেলায় প্রকাশিত হবে সুবিমল বসাকের রচনা সংকলনের প্রথম
খণ্ড(ছাতামাথা, গেরিলা আক্রোশ, আত্মার শান্তি দু’মিনিট ও অযথা খিটক্যাল),
শাবানা আজমির ‘আব্বা’ বইটির অনুবাদ।
সুবিমল বসাক যশপালের হিন্দী উপন্যাস ‘মেরি তেরি উসকি বাত’ বাংলায় অনুবাদের জন্য ২০০৭ সালে সাহিত্য আকাদেমি পুরষ্কার অর্জন করেন।
(২)
বেলঘরিয়ার ইতিহাস প্রসঙ্গে সুবিমল বসাকের কথা লিখছি কেন? ওঁর জন্ম
তো পাটনায়, শিকড় পূর্ববঙ্গের ঢাকায়, তাহলে? উত্তর খোঁজা যাক সুবিমল বসাকের
এক সাক্ষাৎকারেই – “বেলঘরিয়ায় আমি আসি ১৯৬৭ সালে। তার আগে অনেক
আস্তানা বদল করে ডানলপ ব্রিজের কাছাকাছি অশোকগড়ে একটা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতাম।
…অশোকগড়ের বাসা ছেড়ে বেলঘরিয়ায় চলে আসি। প্ল্যাটফর্মে ঘরখালি বিজ্ঞাপন
দেখে স্টেশনের ধারে যে পাড়া পাই, বিবেকানন্দ নগর – বস্তি-কাম-পাড়া – তাতে বাসা নিই। তখনও জানা ছিল না, পাড়াটা বিহারের তুলনাতেও একটি ভয়ঙ্কর জায়গা। আশেপাশে স্বাধীনতা-উত্তর ওয়াগন ব্রেকার, চুল্লুঠেক এবং খুনেদের সমাহার। যে ঘরটায় আমি থাকতাম, তার উত্তরে খোলা মাঠ, এবং ওই মাঠে যে বহু লাশ গুম করা হত সেটা পরে টের পাই। রাতবিরেতে মাতালদের হল্লা, পুলিশের যখন-তখন আস্ফালন এবং ওয়াগন ব্রেকারদের রাজত্ব বিস্তার।”
১৯৮০ সালে বিবেকানন্দ নগরের ভাড়াবাড়ি ছেড়ে বেলঘরিয়ার ভার্নার লেনে নিজস্ব
বাড়ি তৈরি করে স্থানান্তরিত হন তিনি এবং এখনও ভার্নার লেনের ওই বাড়িতেই বাস
করেন। সাহিত্য অনুরাগীদের কাছে দীর্ঘদিন ধরে ‘বেলঘরিয়া’ নামটি উজ্জ্বল হয়ে আছে সুবিমল বসাকের বসবাসের সৌজন্যেই, কেন না এখনও পর্যন্ত তাঁর মাপের কোনো সাহিত্যিকের দীর্ঘ সংস্পর্শধন্য হয়নি এই জনপদ। তাই, পাটনায় জন্ম হলেও, বেলঘরিয়ার সঙ্গে প্রায় পঞ্চাশ বছরের সম্পর্ক যে মানুষটির, তাঁকে অস্বীকার করলে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে কি?
সুবিমল বসাক বেশ কিছু কবিতা লিখলেও তাঁর পরিচয় মূলত গদ্যকার ও
অনুবাদক হিসেবে। তাঁর সাহিত্যকীর্তি নিয়ে আলোচনার জন্য একটি অধ্যায় যথেষ্ট
নয়। সম্পূর্ণ একটি গ্রন্থ রচিত হওয়া উচিৎ শুধুমাত্র লেখার বিষয় ও ভাষার
ভঙ্গি নিয়েই। এখানে সামান্য আভাস দিয়ে রাখি মাত্র…
তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘ছাতামাথা’ বাংলার প্রথম
ডি-ন্যারেটিভাইজড উপন্যাস। গতানুগতিক সূত্র ধরে ঘটনাপ্রবাহে এগিয়ে যাওয়ার
সম্পূর্ণ বিপরীতে দাঁড়িয়ে এই সৃষ্টি। ঢাকার কথ্যভাষায় লেখা এই উপন্যাস শুরু
হচ্ছে এইভাবে – “আন্ধার আর সুমসাম কুঠুরিতে একলা থাকলেই আমার খালি
খালি নরক আর শয়তানের কথা মনে আহে। নরক যাওনের রাস্তাঘাটগুলা চিনা নাই,
চিনাজানা থাকলে মাঝেমধ্যি আওন-যাওন যাইতো। পূজা-পাইলের দিনে তেহার-পরবে
ঐহানে গিয়ে দুই একদিনের লাইগ্যা ঘুইর্যা আওন যাইতো। … হয়তানের কথা হগল
সময়ে মনে আহে, অর কথা ভাইব্যা-ভাইব্যা শরীল নিপাত করি, অথচো কোন কুলকিনারা
পাই না। ক্যান জানি মনে হয়, হয়তানে আমার কাছে পিঠেই আছে। …যারে দেহি তারেই
জিগাই, ‘এখানে শ্রীযুক্ত বাবু শয়তান নামে কেউ থাকেন কি?’” বইটির
উৎসর্গপত্র বাংলা সাহিত্যে আজও মৌলিক। এমনটি আর কেউ লিখতে পারেননি। ষাটের
দশকে বইটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই বাংলার এলিট সাহিত্যমহলে তীব্র সাড়া পড়ে
গিয়েছিল গদ্যের ফর্মের জন্য।
‘হাবিজাবি’ বইটির সব কবিতাই ঢাকাই ভাষায় রচিত। যে কারণে অনেকের
বোধগম্য না হলেও, যারা ধৈর্য ধরে সেই বেড়াটুকু টপকে যেতে পেরেছে, বাংলা
কবিতার এক নতুন ফর্ম উঠে এসেছে তাদের কাছে, যে ফর্মের ধারেকাছে পঞ্চাশ বছর
বাদে আজও কেউ দাঁড়াতে পারেনি। একটি কবিতা তুলে ধরি –
“সারারাত্র বাত্তি আঙাইয়া আমি আর উই শুইয়া কাটাই
নীল হেজহানে লাগালাগি চাম ছেঁওয়াইয়াও কতো আল্গা আছি
অর চ্যারায় কুনো পীরিতের চিন্হী নাই
আমার চ্যারায়ও কুনো পীরিতের চিন্হী নাই
ভয়ান্নক রূপ দেহনের ডরে আমরা দুইজনে চোক্ষু জুইব্বা আছি
তবও নিষ্ঠুরের লেহান আওগাইয়া
কয় দণ্ড মুহূর্ত
কিছুটা সময়-ওক্তো
আমরা ‘পীরিতের খেলা-পীরিতের খেলা’ খেলি।”
লক্ষ্য করবেন, ভাষার আড়ালে জীবনের কী দুর্বিষহ সহনশীলতার কথা উঠে এসেছে কবিতায়। এমনই আরেকটি ‘বকবকানি’ গ্রন্থের ‘জন্মদিনে’ কবিতাটি –
“জন্মদিনে ওড়ানো আটটি সাদা পায়রা, আজ
ফিরে আসে ঊনষাটটি কালো শকুন
চাতালহীন মাথার ওপর তাদের যূথবদ্ধ
অবিশ্রান্ত ওড়াউড়ি
জটিল ও বিশৃঙ্খল ছায়া
দুর্বোধ্য ও পারম্পর্যহীন চিৎকার
আমার সমস্ত মন দূষিত করে তোলে
জানা ছিল না – কী বিশাল রোমশ কালো দাঁত
ছড়ানো চারদিকে
বারবার হড়কে পড়ি কোন এক অদৃশ্য টানে
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে ওঠে দুঃখ-যন্ত্রণা
আজ, আমার মায়ের ঝকঝকে কণ্ঠস্বরও
ধূসর হয়ে পড়ে!”
কোনটা ছেড়ে কোনটার কথা বলি! ‘গেরিলা আক্রোশ’, ‘অযথা খিটক্যাল’,
‘আত্মার শান্তি দু’মিনিট’, ‘গোপন দস্তাবেজ ও শীততাপ নিয়ন্ত্রিত আত্মা’,
‘এখনও কোনো ব্যবস্থা হয়নি – প্রত্যেকটিই গদ্যগ্রন্থ হিসেবে ব্যাতিক্রমী এবং
সুবিমল বসাকের কলমের মুনশিয়ানার চূড়ান্ত পরিচয় পাওয়া যায় এগুলিতে।
সাবঅল্টার্ন অর্থাৎ সমাজের অন্ত্যজ শ্রেণীর লোকেদের কথা তাঁর লেখায় উঠে
এসেছে বারবার, তিনি নিজেও সেই সমাজের মধ্যে দীর্ঘদিন বাস করায়, প্রাণবন্ত
হয়েছে উপস্থাপনা। এই নজির দেখা যায় বিশেষত ‘প্রত্নবীজ’-‘এথি’-‘তিজোরীর ভিতর
তিজোরী’ – এই ত্রয়ী’তে। পাটনায় অবস্থিত বিহারীদের মুখে বাংলা’র যে
উচ্চারণ, সেই ভাষায় রচিত এই তিনটি বই বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ।
পটভূমিকাও বিহারের। সতীনাথ ভাদুড়ী ছাড়া আর কেউ বাংলায় এ ধরণের লেখায় সফল
হয়েছেন কিনা, জানা নেই। সুবিমল বসাক ‘এথি’ ভাষাতেও প্রকাশ করেন, ‘মহল্লা
লোদীপুর’ নামে; এবং বইটি বিহারে দারুণ সমাদৃত হয়। লেখক নিজেও বিশ্বাস করেন,
তাঁর ‘প্রত্নবীজ’ বইটি একদিন সমাদৃত হবেই বাংলার পাঠকসমাজে।
১৯৮৭ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর একটি অনন্যসাধারণ গবেষণাগ্রন্থ – ‘বিয়ার গীত ঢাকাই ছড়া’। লেখক তাঁর এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন – “বিয়ার গীত সংগ্রহ করাটা ছিল অন্যপথে। জনৈক স্বজাতির বিয়েতে হাজির হয়ে দেখেছি, কয়েকজন প্রৌঢ়া-বৃদ্ধা তাঁদের শেষ কামড় দিচ্ছে। আমি সংগ্রহ করতে শুরু করি। নদীয়া-ফুলিয়া অঞ্চলে গিয়ে কিছু সংগ্রহ করেছি। এই রীতি-নীতি, গীত, পদ এখন লোপ পেয়েছে বলা চলে। মীজানুর রহমান ‘বিয়ার গীত’ প্রাপ্তিস্বীকারে লিখেছিলেন – ‘এই বিরাট মাপের কাজটি আমাদেরই করার কথা, আপনি কাজটি করে আমাদের স্মৃতি উসকে দিয়েছেন। বাংলাদেশে প্রত্যন্ত এলাকায় এখন মাইকেল জ্যাকসন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে’। মীজানুর রহমান তাঁর পত্রিকায় পুরো বইটি ছেপেছেন।” বইটির প্রথম অংশ ‘বিয়ার গীত’। এখানে লেখক ঢাকার হিন্দুদের বিবাহের আচার-আচরণ, নিয়ম ও তৎসংলগ্ন গানের বর্ণনা দিয়েছেন। “ঢাকায় প্রচলিত বিয়ে উপলক্ষে গানকে ‘বিয়ার গীত’ বলা হয়। কেবল ঢাকা নয়, সমগ্র ঢাকা জেলায় ‘বিয়ার গীত’ বলে প্রচলিত… এইসব গানে তখনকার কাল যুগ পরিবেশ ইত্যাদির একটা মোটামুটি আভাস পাওয়া যায়, তখনকার সময়ের সহজ সরল অনাড়ম্বর অনুভূতির রেশ এই সব বিয়ার গীতে উপস্থিত থাকে”।
হারিয়ে যাওয়া সংস্কৃতির শেষ অস্তিস্ত্বটুকু লেখক অমর করে রেখেছেন তাঁর এই
গ্রন্থে। বইটির দ্বিতীয় অংশে আছে প্রচুর ছড়া, যা ঢাকার অধিবাসীদের মুখে
মুখে পরম্পরায় প্রচলিত। সেসব স্মৃতিমেদুরতায় ভারাতুর, অনায়াসে হাত ধরে নিয়ে
যায় শৈশবে। দুঃখ হয় যখন দেখি, বাংলার তথাকথিত সংস্কৃতিমনস্ক মানুষেরা
বইটির সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন আদৌ।
‘কুসংস্কার ১৫৫’ বইটিতে সংকলিত আছে বাংলায় প্রচলিত ১৫৫টি
কুসংস্কার; যা সুবিমল বসাক দীর্ঘ অনুসন্ধানের মাধ্যমে সংগ্রহ করেছিলেন।
‘কুট্টি’ হল ঢাকার গাড়োয়ানদের মুখে মুখে প্রচলিত রসিকতার এক অনবদ্য সংকলন।
অবাক লাগে, পারিপার্শ্বের যথাযোগ্য সহযোগিতা না পেয়েও তিনি কীভাবে লিখে
গেছেন একের পর এক বই। সমান্তরালভাবে বেরিয়েছে অনুদিত গ্রন্থগুলিও। তাঁর
স্মরণযোগ্য একটি উপন্যাস ‘দুরুক্ষী গলি’, এবং উপন্যাস হিসেবে হয়তো
সর্বোত্তমও। চলিত বাংলায় লেখা হলেও বইটির পরতে পরতে মিশে আছে ফেলে আসা
ঢাকা’র স্মৃতি। অভিজ্ঞতা ছাড়া এমন উপন্যাস লেখা যায় না। মলয় রায়চৌধুরী
আমাদের একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, এই উপন্যাসটি লেখকের সেরা রচনা; এমন
বিষয় নিয়ে আগে কেউ লেখেনি, পরেও কেউ লিখবে না সম্ভবত। স্বর্ণকারদের
দৈনন্দিন জীবন ও জীবিকার এমন সূক্ষ্ম বর্ণনা অভিজ্ঞতা ছাড়া লেখা অসম্ভব।
এবং ঘটনাপ্রবাহে আকর্ষণীয় করে তোলাও একটি শিল্প। বহুকাল আগে মুর্শিদাবাদ
থেকে একদল তাঁতি ইংরেজদের অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে পূর্ববঙ্গে পালিয়ে
গেছিলেন, বিশেষত ঢাকায়। সেখানে স্বর্ণকারবৃত্তি’কেই তাঁরা জীবিকা হিসেবে
বেছে নেন। তারপর, গত শতকের চল্লিশের দশকে অনেকেই পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন,
দেশভাগের পূর্বাভাস পেয়ে। তাঁদের কয়েকজন বিহারের পাটনায় স্বর্ণকারের জীবিকা
বজায় রাখেন। তাঁরাই উপন্যাসের নায়ক। সময়ের হাত ধরে এই উপন্যাসে উঠে এসেছে
দেশভাগ, ঢাকা’র স্মৃতি, বিবাহের রীতি, কৈশোরের অনুভূতি, যৌনতার স্বাদ। এবং
পরিসমাপ্তি চীন-ভারত যুদ্ধের আঙিনায়। বাংলা সাহিত্যে সম্ভবত আর কোনো
উপন্যাসে ৬১’সালের চীন-ভারত যুদ্ধের পটভূমিকা আসেনি। ‘দুরুক্ষী গলি’ হল
পাটনার প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি রাস্তা, যেখানে স্বর্ণকারদের বাস। তাঁদের
আচারে কল্পনায় যাপনে উঠে আসে ঢাকা’র ফেলে আসা দিনগুলো। যে কারণে তারা বলে
ওঠে – “খালি কলমের আঁচড় কাটল – ওমতে দেশভাগ। আমগো লগে থাকতে হইলে এই
দ্যাশে আসতে হইব। হ। আরে, লোকজনের কত কষ্ট, কত দুর্দশা, কত ছিদরত, বাড়িঘর
সাত পুরুষের ভিটা ছাইড়্যা, চিরদিনের মতো চইল্যা আসন কি মুখের কথা! নাড়ির
টান পড়ে”। সম্পূর্ণ সাবঅল্টার্ন অবস্থান থেকে লেখা এই
উপন্যাসের পরিণতিতে অস্তিত্বের সংকট কী করুণভাবে বর্ণিত হয়েছে তা সত্যিই
দেখার মতো। একবার ঢাকা থেকে উচ্ছেদ হলেও যেসব লোকেরা নিজেদের জীবিকা ত্যাগ
করেনি, ভারত সরকারের ‘গোল্ড কন্ট্রোল’ আইনের ঠেলায় তাদের আত্মপরিচিতি
কিভাবে অভাবের সঙ্গে সঙ্গে বিলুপ্ত হয়ে গেল – সেই বাস্তবের এক মর্মন্তুদ
দলিল এই উপন্যাস।
সুবিমল বসাক হলেন সেই সাহিত্যিক, যিনি হাংরি আন্দোলনের সময়কাল
থেকে এখনও সমান সক্রিয় এবং সৃষ্টির অদম্য তাড়নায় লিখে যাচ্ছেন আজও। অসংখ্য
গল্প, কবিতা ও প্রবন্ধ এখনও গ্রন্থিত হয়নি। প্রকাশিত বইগুলিও দুস্প্রাপ্য।
আমাদের দেশে ফ্লিমস্টারদের খ্যাতি আকাশচুম্বী, অথচ সুবিমল বসাকের মতো একজন
সাহিত্যিক নূন্যতম সম্মানটুকুও পান না সমাজ থেকে। কেন? তথাকথিত নামী
প্রকাশনা থেকে তাঁর বই এখনও বেরোয়নি বলে? মানুষটি প্রচারবিমুখ বলে? না
আমাদেরই উদ্যমের অভাব ও সংকীর্ণ মানসিকতা? আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ভীষণ
প্রয়োজনীয় প্রশ্ন এটি।
(‘বেলঘরিয়ার ইতিহাস সন্ধানে’ বই থেকে)
সুবিমল বসাকের ‘গেরিলা আক্রোশ’ – একটি অবচেতনার দলিল : তন্ময় ভট্টাচার্য
“জন্মসূত্রে পাওয়া আতঙ্ক ভয় ত্রাস – যা থেকে মানুষের
নিস্তার নেই – লক্ষলক্ষ শ্বেত কপোত উজ্জ্বল আলো স্কাইক্র্যাপার্স পরিকল্পনা
রাজনৈতিক রাডার সোনালী ভবিষ্যৎ কিছুই এই অন্তর্নিহিত সংকট থেকে উদ্ধার
করতে পারেনি – মানুষকে অনায়াসে ঢূকে পড়তে হয় এক অদৃশ্য ঘেরাটোপে – যার
সেলোটেপ সরাতে গিয়ে আঙুল দুমড়ে শীর্ণ হয়ে আসে শিরদাঁড়া বেঁকে নুয়ে পড়ে –
তবুও ঐ শীর্ণ আঙুলে ভাঙা শরীরে প্রতিরোধ চালিয়ে যায় – স্বাধীনতাকামী মানুষ –
তার আক্রোশ -” এই হলো বইটির উপজীব্য। সুবিমল বসাক হাংরি আন্দোলনের একজন
সামনের সারির সৈনিক যার কলমে ফুটে উঠেছে সামাজিক তথা মানসিক বিপন্নতার
সুচারু চিত্র। এমনই পাঁচটি গদ্যের সংকলন ‘গেরিলা আক্রোশ’। প্রকাশকাল ১৯৭৪।
এতদিন পর গ্রন্থটির সমালোচনা করা কিছুটা ধৃষ্টতা তো বটেই, কারণ কালের
স্বাভাবিক নিয়মে একশ্রেণীর উৎসাহী পাঠকের কাছে সমাদৃতও হয়েছে বইটি। তবু
সম্পূর্ণ অন্য ধারার এই গদ্য সংকলনটির স্বাদ আরও বৃহত্তর ক্ষেত্রে পৌঁছে
দেয়ার জন্যেই এই প্রয়াস।
প্রথম গদ্যটির নাম ‘গেরিলা আক্রোশ’। লেখকের যৌবনোচিত মানসিক
অস্থিরতার কথা ফুটে উঠেছে এতে। প্রধান উপাদান একটি ডাইরি ও একটি
বেতারযন্ত্র। ডাইরির পাতা উল্টাতে ভয় করে তাঁর, কেননা তখনই “বুকের ভেতর
রক্ত তোলপাড় শুরু করে দেয়। ঘরের একপাশ অন্ধকারে ছেয়ে থাকে, বাতি জ্বালাতে
গিয়ে আলো বেরোয় না।” বিভিন্ন প্রতিকূল অভিজ্ঞতায় জর্জরিত লেখক ডাইরির কাছে
এসে নিছক স্মৃতির আক্রমণের ভয়েই অবচেতনে গড়ে তোলেন বিরূপতা। আর তার থেকে
মুক্তি পেতে বেতারযন্ত্রের শরণাপন্ন হন তিনি, এবং সেই বেতারেও জন্মাবধি
তাঁর সমস্ত ইতিহাস ও অভিজ্ঞতা ধ্বনিত হতে থাকে। অসহায় লেখক স্বস্তি পান
বেতার থামার সঙ্গে, এবং তিনি শেষ পর্যন্ত আবার ফিরে আসেন ডাইরির কাছেই। সব
মিলিয়ে এক আশ্চর্য জীবন ও মনের ছবি খুঁজে পাই এই গদ্যটিতে যার পরতে পরতে
মিশে আছে শান্তির জন্য হাহাকার।
দ্বিতীয় গদ্য ‘আগ্রাসী অপকর্ম’। লেখকের চারপাশে অজস্র শব্দ এবং
সেই শব্দের কাছে ধরাশায়ী তিনি। শয়নে স্বপনে জাগরণে বিভিন্ন শব্দ ও তার
অশান্ত ফল চাবুকের মতো তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় লেখক-কে, কিন্তু শব্দহীন সেই
স্থান অধরাই থেকে যায়। এমনকি ঘড়ির মধ্যে থেকেও লেখক শুনতে পান এক গম্ভীর
কন্ঠস্বর – “পৃথিবীর প্রতিটি পিতা তার পুত্রকে পুরুষ বন্ধুর সঙ্গে এবং
কন্যাকে মহিলা বন্ধুর সঙ্গে মিশতে দিচ্ছে।” শব্দের পীড়ন লেখককে আতঙ্কিত করে
তোলে। রেডিয়ো’র নব ঘোরাতেই দুম্ ক’রে ঘোষিত হয় – “জন্ম-মুহূর্তে কেউ
নবজাত শিশুর মুখের দিকে চেয়ে দেখে না।” শব্দ তোলপাড় হতে থাকে। এমনকি ‘মগজে
প্রতিরোধহীন টুপটুপ রক্ত চুঁইতে থাকে’, টেপরেকর্ডার শুনিয়ে যায় জাম্পকাট
ঘটনাবলী – অসহ্য একঘেয়েমির শেষ হয় ফিতে ছিঁড়ে গেলে। তখন পুনরায় অন্যান্য
শব্দ জোরদার হয়ে ওঠে। “কানের কাছে বিশৃঙ্খল পারম্পর্যহীন শব্দাবলীর প্রতি
মন রেখে বুঝতে পারি, আজীবন এই গাদাগাদা শব্দের মরণাক্রমণ আমাকে সহ্য করতে
হবে। তা থেকে আমার নিস্তার নেই, কেননা মৃত্যুই শব্দহীনতা”। এই শাশ্বত
উপলব্ধির কাছে নতজানু হয়ে এবং অসহায়তার কাছে আত্মসমর্পণ করেই শেষ হয় লেখকের
যাত্রা।
তৃতীয় গদ্যটি হলো ‘হুঁশাহুঁশহীন ছোবল’। অবচেতনের এক অনবদ্য ছবি
ফুটে উঠেছে লেখাটিতে। ফাঁকা ঘরে লেখক স্মৃতি হাতড়াতে যখন বুঁদ, দরজার বাইরে
এক বিড়ালের ডাকে ঘোর কাটে তাঁর। “ওর চোখদুটো ভয়ানক জীবন্ত দেখায়।…কেমন যেন
কুঁকড়ে সিঁটিয়ে পড়ি…এতক্ষণের স্মৃতি চিন্তা ধারণা বাল্যকাল ডাইরি প্রেম
ভাবনা সব ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে।” ক্রমশ বিড়ালের অবয়ব পাল্টাতে পাল্টাতে লেখক
দেখেন তাঁর মৃত পিতার প্রতিকৃতি। সেটিও বদলে যায় একটি ঝুলন্ত জিভে – গলন্ত
সেই জিভ এগিয়ে আসে লেখককে লেহন করতে। মনের পর্দায় একের পর এক ঘটনাপ্রবাহ
চলতে থাকে সিনেমার মতো, মধ্যে মধ্যে স্নায়ুতন্ত্রীতে বেজে ওঠে “বাবা এসেছে
বাবা এসেছে বাবা এসেছে বাবা এসেছে বাবা এসেছে…”। সমস্ত চিন্তা জট পাকিয়ে
যায়। হাল ছেড়ে দিয়ে লেখক বলেন, “এখন দীর্ঘসময় চিন্তা ভয়হীন আমি ঘুমিয়ে
থাকতে চাই – জানি, আমার এই ঘুম কখনও ঘটবে না।” দক্ষ শব্দশিল্পী না হলে
অবচেতনকে এভাবে ফুটিয়ে তোলা যায় না, আর এখানেই সুবিমল বসাকের সার্থকতা।
“চোখের পাতা নামালেই সেই সেলুলয়েড… আমার শরীর ভারী ও হিম করে
তোলে, হাত নাড়াবার মত শক্তি সামর্থ্য হারিয়ে ফেলি। ভিজে কামান নেতিয়ে থাকে
হাঁটুর দেয়ালে।” – চতুর্থ গদ্য ‘অপ্রতিরোধ্য ভাইরাস’-এ বলা আছে
স্বপ্নদোষের পর ঘুম ভেঙে-যাওয়া এক যুবকের কথা, অস্বস্তির চরম সীমায় পৌঁছে
যে আঁকড়ে ধরতে চায় অরুণিমার শরীর। যুবকটি মন ঘোরানোর জন্য পড়তে শুরু করে
একটি প্যানপ্যানে প্রেমের কাহিনী। কিন্তু সেই আপাত-গতানুগতিক কাহিনী পাঠের
মধ্যে-মধ্যেও যুবকের স্মৃতিতে ঝলকানি দিয়ে ওঠে আধিভৌতিক দৃশ্যকল্প। ক্রমশই
“অরুণিমার হাঁ ক্রমশ বড়ো হতে হতে ভয়ঙ্কর হয়ে পড়ে… হাত টুক্ করে পড়ে যায়
বাহুমূল ছিঁড়ে তারপর পা স্তন সব বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে থাকে…”। কাহিনীও এগিয়ে
চলে বিয়োগের দিকে, সমান্তরালভাবে যুবকের মানসিক আলোড়নও চরম বিন্দু থেকে
ক্রমশ শিথিল হয়ে যায়। বলা বাহুল্য, এখানে যুবকটি লেখক নিজেই।
পঞ্চম ও শেষ গদ্যটি হলো ‘তেজস্ক্রিয় দুঃস্বপ্ন’। এবং সম্ভবতঃ
সবচেয়ে তেজস্ক্রিয় গদ্যও এটিই। একটি বাসযাত্রার বর্ণনা, যেখানে লেখক সিট
পান জানলার ধারে বসা একটি যুবতীর পাশে। “মেয়েটি সিঁটিয়ে বসে আছে। শাড়ির
ভাঁজে সংকোচ ভাব। আমার অস্বস্তিবোধ হতে থাকে। ওর অস্বাভাবিকতার জন্য আরও
বেশি বিচলিত বোধ করি।” তারপর বয়সের স্বাভাবিক ধর্মে লেখক ক্রমশ আকৃষ্ট হন
যুবতীর প্রতি, বাসের মধ্যেই যুবতীর চোখ বাহু ও স্তনের আভাস তাঁকে উত্তেজিত
করে তোলে। “মেয়েটির প্রোফাইলে উজ্জ্বল আয়নার মত ঝকঝকে সিঁদুরে আলো –
কিছুক্ষণ একদৃষ্টে চেয়ে থাকলে শিরদাঁড়া শিরশির করে ওঠে।” এরপরই যুবতীর
ব্লাউজসিঞ্চিত স্তন ও লেখকের কনুইয়ের ঈষৎ স্পর্শমেদুরতা – এবং কামোদ্দীপনা –
হয়তো তা উভয়ার্থেই। কিন্তু হঠাৎই বাসটির মৃদু অ্যাকসিডেন্ট এবং তারপর থেকে
লেখকের মানসিকতার চূড়ান্ত মোড় ও চেতন-অবচেতনের নিদারুণ ছলনা গদ্যটিকে
অমরত্বের পর্যায়ে নিয়ে যায়। অপূর্ব এই গদ্যটি – যাকে ‘জীবনদর্পণ’ বলতেও
কোনো দ্বিধা নেই – বাংলা সাহিত্যের একটি উল্লেখযোগ্য সম্পদ।
সুবিমল বসাক গতানুগতিক লেখকদের থেকে সম্পূর্ণ অন্য পথে হেঁটেও
যে কীর্তির নজির রেখেছেন, তাতে তাঁকে অবজ্ঞা করার কোনো উপায়ই নেই। তাঁর
ভাষা অননুকরণীয়। আর, ‘গেরিলা আক্রোশ’ বইটি তো যেকোনো যুবকের মানসিকতার এক
অত্যুজ্জ্বল প্রতিফলন। সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতার পরিবর্তে মানসিক
ক্ষুধা ও অনুভূতিকেই সুবিমল বসাক বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন এই পাঁচটি
ভিন্নধর্মী গদ্যে; আর তাই নিঃসন্দেহে বলা যায়, কালের সীমা পেরিয়েও অক্ষুণ্ণ
থাকবে ‘গেরিলা আক্রোশ’ ও তার দ্যুতি।
সুবিমল বসাকের কবিতা – হলদেটে পাতার আড়ালে : তন্ময় ভট্টাচার্য
(১)
প্রতি রাত্র
আমার লগে বেইমানি করে ম্যায়ামানুষের লেহান
নিখুঁত
ম্যায়ামানুষের লগে
অহন আর কোনো সম্পক্ক নাই আমার
তবভি
পুরানা স্মৃতি
আমারে বারবার ছোবল মারতে থাকে
আমি তাগো ভালাবাসি
ভালবাসার গাঢ়ভাব না দেইহা।
(হাবিজাবি – ২১)
স্বীকারোক্তির বিভিন্ন ধরণ থাকে। বেশিরভাগই প্রচ্ছন্ন। আমাদের
পাঠকমন তাতে হাবুডুবু খায়, ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ গোছের একটা ডিসশানে এসে
সুখটান মারে সিগারেটে। এমন অভ্যাসে “আমি তাগো ভালাবাসি/ভালবাসার গাঢ়ভাব না
দেইহা” – এসব কথা মুখোশ টেনে ধরে, চচ্চড় করে আঠা, আঁকড়ে রাখতে চাই, ছাল উঠে
যায়। স্পষ্ট কথায় কষ্ট আছে তো বটেই! আমরা বাপ-মায়ের আহ্লাইদ্যা পুলা,
কবিতা বলতে বুঝি পান্তাভাতের সঙ্গে পেঁয়াজ কামড়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর; সেখানে
অনভ্যস্ত পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট আর গ্লিসারিনের বিক্রিয়া আগুন তো
জ্বালাবেই! বালিশ তোশক কম্বল চাদর হাতের কাছে যা কিছু পাই তা দিয়ে চেপে
ধরি, ছড়িয়ে যায় আরো। জল ঢালি। পোড়া গন্ধ। নাক কুঁচকাই। হো হো করে হেসে ওঠেন
সুবিমল বসাক।
এখানেই চুপ করা যেত। কিন্তু ফাঁক গলে ঢুকে পড়ছে সিনিয়ার
কণ্ঠস্বর। ঢাকাইয়া ভাষায় হাবিজাবি কিছু লিখলেই সেটা কবিতা হয়ে যাবে?
মামদোবাজি নাকি? আমরা এতদিন ধরে ঘষে ঘষে পাছার আদ্ধেক মাংস ক্ষইয়ে
মৌরসিপাট্টা দখল করলাম, আর কোথাকার কোন পাটনার ছেলে এসব স্টান্ট দেখিয়ে
হাততালি নেবে? শাশ্বত বোঝে? অমরত্ব জানে? আনন্দ ওর বই ছাপিয়েছে? অমুক
স্মৃতি পুরষ্কার পেয়েছে? তমুকের বৌয়ের সঙ্গে পার্টিতে ছবি তুলেছে? তাহলে
কীসের কবি হে! চেষ্টা করুক, ওরও হবে। হতেই হবে। আমরা আছি না…
(২)
আরশির ওই পাড়ে ফুটছে শয়তানের চ্যারা
ফিরা ফিরা প্রতিশোধ লইতে তেইড়্যা আহে
আমার উল্টাহানই আমি নিত্য দেহি আরশিতে।
(হাবিজাবি – ১২)
মেলা বিপদে ফেললেন মশাই! চেপেচুপেই রেখেছিলাম এতদিন! ‘কেটেছে
একেলা বিরহের বেলা/আকাশকুসুম চয়নে’ গাইতে গাইতে দিব্যি তো ফুলটুশকুমার আছি;
ছিপে যদি মাছ না ওঠে, চালাও পানসি বেলঘরিয়া! ওইসব আয়না-টায়নায় দাঁড়াতে
গেলে, বিবেকের গুঁতোয় মাথা মুড়িয়ে সন্নেসী হয়ে যাব যে! হ্যাঁ, আমি জানি আমি
শয়তান, মাল্টিপল ডেফিনেশনের সবকটাই অ্যাপ্লাই করা চলে আমার ওপর। তা বলে
সুন্দর করে রঙ মেরে রেখেছি যে পরিচয়ে, খুঁড়ে বের করতে যাব কোন দুঃখে? একটা
প্রেস্টিজ আছে না? ওসব পাপবোধ-টোধ প্রথমদিকে অনেক হত, এই বুঝি কেউ এসে
ছিঁড়ে দেবে সাধুপুরুষামি; ঘুম হত না অনেকদিন। নিজের মুখ নিজেকেই দেখানো যায়
না, আয়নায় দাঁড়াবো কীভাবে? আড়চোখে দেখলেও একটা ছোটোলোক কোত্থেকে এসে
ভ্যাঙাতে থাকে। চাবকাতে থাকে সারা শরীরে। তবে ভুলেও থাকা যায়। ফুর্তিসে
বাঁচো, গুলি মারো ওসব হিস্ট্রিতে। আস্তে আস্তে সব ফিকে হয়ে যাবে।
বাই দ্য ওয়ে, আপনি জানলেন কীভাবে? কবি না গুপ্তচর মশাই?
(৩)
তোমার ওই ব্যবহার-তরিবতে
আলগা-পীরিত ছাপাইয়া ওঠে
দেহন-মন্তরে সীনার ভীৎরে যন্তন্না টাটায়
আমি আওগাইয়া যাই তোমার লাগ্
পুরানা ঘটনা রক্তে অহন বিষের লেহান্
সময়েতে ছোবল মারে নীল নীল
তোমার লগে মেল বয়না এতটুক্
তবভি আওগাইয়া যাই তোমার লাগ
ধোন্ধের লেহান কেবল ঘুইর্যা মরি।
(হাবিজাবি – ১৯)
স্বীকার করুন বা নাই করুন, ল্যাং খাওয়া মানুষ আর ঠ্যাং খোওয়া
মুরগির মধ্যে প্রধান পার্থক্য হল ইচ্ছের। মানুষটি অন্ধকার ঘরে হলেও
আশায়-আশায় বসে থাকে, কোনোদিন যদি ফিরে আসে! আর মুরগি দুঃখে হতাশায় নিজেকেই
তুলে দেয় হত্যাকারীর হাতে। ঝুলে থাকতে কারোরই বিশেষ আপত্তি নেই – একজন
আধমরা, অন্যজন পুরোটাই। কিন্তু যেখানে-সেখানে পালক ছড়িয়ে নিজেকে ঘিনঘিনে
করে তুলতে পারে না বলেই মানুষ কোনোদিন মুরগি হতে পারবে না। প্রেমিকই থেকে
যাবে।
এই যে ‘আলগা-পীরিত’টির কথা সুবিমল বসাক লিখেছেন, লেখেননি
নেলপালিশরঙা আঙুলের কথা। দুটো মিলে যে আঁচড়, তাতেই জ্বলে ওঠে পুরুষের
যাবতীয় লাগাম-প্রবণতা। বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়, ‘হ্যাঁ, আমিও ভালোবাসা
পাওয়ার যোগ্য’। এবং, সত্যি বলতে, ফুল ফল গাছ পাখি চাঁদ তারা নদী ইত্যাদি
সবকিছু এই আটফুট-বাই-ছয়ফুট ঘরের মধ্যে উপচে পড়ে। সাঁতার না জেনেও সাঁতরাতে
ইচ্ছে করে, চুমু খেতে না জেনেও মনে হয় ইমরান হাসমি তো বাচ্চা ছেলে! আকাশে
ঝিলিক মারতে থাকে অসময়ে চোখের বিদ্যুৎ।
এরপর বাজ-পোড়া গাছ। কখন যে ঝলসে গেছেন, বুঝতেই পারবেন না। হাত
বাড়াচ্ছেন, ধরার বদলে ঢেলে দিচ্ছে যন্ত্রণার অ্যাসিড। সাধে কি মলয়
রায়চৌধুরী বলেছেন – “আজ মনে হয় নারী ও শিল্পের মতো বিশ্বাসঘাতিনী কিছু
নেই”! আপনার মনে ফিরে-ফিরে আসবে ফেলে আসা দিনের স্মৃতি, যাকে এত ঘনিষ্ঠ
চিনতেন, আপনার উপস্থিতি তার কাছে হয়ে উঠবে বিষময়। তবু আপনাকে যেতেই হবে।
বিজ্ঞানের যুগেও এ এক অদ্ভুত নিশিডাক। যাবেন, অপমানিত হবেন, ফিরে আসবেন,
আবার যাবেন। সাইক্লিক প্রসেস। ফাইনালি, একদিন মুরগির মতো ঠ্যাং তুলে মরে
যাবেন।
এটুকু সান্ত্বনা যেন সেদিনও থাকে যে, আপনি আসলে প্রেমিকই ছিলেন, মুরগি না…
(৪)
সারারাত্র বাত্তি আঙাইয়া আমি আর উই শুইয়া কাটাই
নীল হেজহানে লাগালাগি চাম ছেঁওয়াইয়াও কতো আল্গা আছি
অর চ্যারায় কুনো পীরিতের চিন্হী নাই
আমার চ্যারায়ও কুনো পীরিতের চিন্হী নাই
ভয়ান্নক রূপ দেহনের ডরে আমরা দুইজনে চোক্ষু জুইব্বা আছি
তবও নিষ্ঠুরের লেহান আওগাইয়া
কয় দণ্ড মুহূর্ত
কিছুটা সময়-ওক্তো
আমরা ‘পীরিতের খেলা-পীরিতের খেলা’ খেলি।
(হাবিজাবি – ৪)
তারপর, পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ি। ভালোবাসা যখন বাধ্যতায় পরিণত হয়,
তার থেকে কষ্টকর আর কিছুই নেই। ছেড়ে আসার পথ বন্ধ, কারণ আপনি দায়িত্ব
নিয়েছেন; ভুলে যাওয়ার ক্ষেত্রেও আঙুল তোলে শিষ্টাচার। প্রতিবাদ তখনই সফল
হয়, যখন পিছুটান ফেলে আসা যায়। আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়েও ঘেন্না নিয়ে বেঁচে
থাকি বলেই আমরা সংসারী। আমরা অসহায়। পূর্বনির্দেশিত বেশ কিছু নিয়মের মধ্যে
একটা হল অপরকে তৃপ্ত করা। মনের খবর ক’জনই বা রাখে! শরীরে শরীর লেগে আগুন
জ্বলে ওঠাই যেন সাম্যবাদের শ্রেষ্ঠ সাফল্য। বিশ্বাস করুন, আমি-আপনি তখন
একটা যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই নই। ওয়েল্ডিং মেশিনের সঙ্গে আমাদের কোনো
পার্থক্যই নেই।
ভালোবাসাহীন এই মিলনে মরে যেতে যেতে আর কতদিন সামাজিকতার পরীক্ষা দিতে হবে, বলতে পারেন?
(৫)
২৬নং রাস্তার চৌমাথায় আইয়া দেহি
ম্যায়ামানুষ খাড়াইয়া আছে সটান
শরীল লইয়া আওগাইয়া আহে, পুরুষের হুম্কে
আমি আঙুলের ইশারা করতেই খোলস্ ছিড়্যা বাইরইয়া পড়ে লাল ফুল
সোন্দর পাপড়ি ছিড়্যা দাঁতে চাবাইয়া দেহি,
অহন আর কুনো সোয়াদ পাই না
গাড়ীর লামাৎ কেউ চাপা পড়লেও অস্থির হই না
এই শহরের নিশ্বাসে আমার কইল্জা পুইড়্যা গেছে
আন্ধারে কেবল বিড়ালের লাল চক্ষু জ্বল জ্বল করে
(হাবিজাবি – ২৩)
টইটম্বুর হয়ে আছেন। একটা টোকা মারলেই ফুটপাথ ভেসে যাবে
বিরক্তিতে। সিগারেট খেয়ে খেয়ে মুখের ভেতরটা পানসে। চুমু খেতে চাইছেন কি?
সাবধান! বিষ যখন অমৃতের বেশে ধরা দেয়, তার থেকে বিপজ্জনক আর কিছুই হতে পারে
না। হাতছানি। শক্ত হচ্ছেন। কাছে এগিয়ে এল। শক্ত। আহ্বান। ঝাঁপালেন। আবার
বিরক্তির শুরু…
কোথায় যাওয়া যায় বলুন দিকি? মর্গের দেয়াল ছেয়ে গেছে সিনেমার
পোস্টারে। থানার বাইরে পাবলিক টয়লেট। মন্দিরের চাতালে জুয়ার আড্ডা। ন্যাংটো
ছেলে পুরুষ হতে চাইছে। ফুটপাথে ঘন্টা থাকে না। সাইরেন। কোথায় পালাবেন?
মৃত্যু এখন জলভাত। খালাসিটোলা? বড্ডো ভিড়। একা হতে চাই। আপনিও কি? চলে আসুন
তাহলে আমাদের একমেবাদ্বিতীয়ম কুঠুরিতে। যেখানে জয়েন্ট মানে শুধুই পরীক্ষা
নয়। চোখ লাল হলে অন্ধকারের ভয় দেখাবে না কেউ। নরম গদির পাশে একট পিকদানি ও
একটা তবলচি পেলে আপনিই আজ রাতের নবাব।
মুজরোর চিন্তা নেই। তিলোত্তমা ঘাঘরা ওড়াতে পারে ভালো…
কাব্যগ্রন্থ – হাবিজাবি
কবি – সুবিমল বসাক
প্রথম প্রকাশ – ১৯৭০
রচনাকাল – ১৯৬৩-৬৮
সুবিমল বসাকের মুখোমুখি তন্ময় ভট্টাচার্য
প্রশ্ন – সাহিত্যে নিষিদ্ধতা বলতে আপনি কী বোঝেন?
সুবিমল বসাক – সাহিত্য আমরা দু’ভাবে দেখি – একটা সিদ্ধ, একটা
নিষিদ্ধ। সিদ্ধ মানে যেটা চলে আসছে কোনো বাধা ছাড়াই, আর নিষিদ্ধ মানে যেটা
সহজভাবে কেউ গ্রহণ করছে না। আমাদের মামলা-মোকদ্দমার সময় জেনেছি, হাইকোর্টে
‘নিষিদ্ধ’ বলতে ঠিক কী বোঝায়। এমন বহু শব্দ আছে, যেগুলো সকলের সামনে
উচ্চারণ করা যায় না। অবসিনিটি বা নিষিদ্ধতা শুধু লেখার ওপরেই নয়; ছবি,
দৃশ্য সবকিছু মিলিয়েই। সকলের সঙ্গে, গোটা পরিবারের সঙ্গে বসে দেখা যায় না
এমন দৃশ্য। যেগুলি শরীর, মন, চেতনা সব মিলিয়ে অদ্ভুতভাবে নাড়া দেয়। সেই
নাড়া’টা নিশ্চই ভালো নয়, তাই সেটা নিষিদ্ধ হয়েছে। ‘নিষিদ্ধ’ বলতে, এককথায়,
যেটার সম্মুখীন আমরা সচরাচর হই না। এই ব্যাপারটা পূর্বপুরুষেরা আমাদের ওপর
চাপিয়ে দিয়েছেন। সচরাচর কোনো কথা, কোনো ব্যবহার, কোনো বিষয়, কোনো পরিবেশ
যখন দেখি আমাদের সংস্কারের সঙ্গে মিলছে না, তখন সেটাকে নিষিদ্ধ বলি। কিন্তু
কবিতায় বা গদ্যের কোনো শব্দ, যেটাকে বলা হচ্ছে অশ্লীল, অথচ যেটা জীবনের
সত্য, সেইসব শব্দের ব্যবহার আগেকার যুগে যে চলেনি তা নয়; সংস্কৃত সাহিত্যে
দেখা যেত, কিন্তু সেটা ছিল অনেক ওপরতলার ব্যাপার; অর্থাৎ আগে সংস্কৃত পড়তে
হত, তার অর্থ বুঝতে হত। কিন্তু এখন বাংলায় লিখলে, লোকে যেহেতু পড়তে পারে,
বুঝতে পারে, সেই কারণে নিষিদ্ধ ব্যাপারটাকে চিহ্নিত করে নেয় তাদের মতো করে।
একটা লেখা যখন সাহিত্যে উত্তীর্ণ হয়, তাতে শ্লীল-অশ্লীল কোনো ব্যাপারই নয়। তখন সাহিত্য ওপরে উঠে আসে, বাকি বিষয়গুলো চলে যায় বাইরে।
প্রশ্ন – হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে অনেকের ধারণা, মূলবোধহীন
কয়েকটি যুবক শুধুমাত্র নাম কেনার উদ্দেশ্যে লেখায় ভালগারিটি নিয়ে এসেছিল।
সত্যিই কি তাই?
সুবিমল বসাক – যে সাহিত্যধারাটা চলে আসছিল, তার বিরুদ্ধে একটা
ধাক্কা দেয়ার দরকার ছিল। সেটাই আমরা করেছি। কিন্তু নাম কামাবার কোনো
ব্যাপার ছিল না। আসলে আমাদের আগেকার লোকেরা কিছুটা হয়তো আমাদের চেপে রাখতে
চেয়েছিল। তাই এইসব প্রচার।
প্রশ্ন – হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে আপনারা যদি যুক্ত না থাকতেন, তাহলে আজ আপনাদের যে পরিচিতি, এতটা ছড়ানো সম্ভব হত?
সুবিমল বসাক – একদিক দিয়ে প্রশ্নটা ঠিকই। হাংরি আন্দোলন আমরা
কয়েকজন মিলে করেছিলাম। তখন যে সমস্ত লেখা হয়েছিল, সেটা তো প্রচলিত
সাহিত্যধারার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। ভাষার ব্যবহার, বিষয় – সবক্ষেত্রেই। অথচ
অনেকে বলে, ‘ওরা তো হাংরি লেখক!’ যেন লেখালিখি ছেড়ে অন্যান্য ব্যাপারের
সঙ্গে যুক্ত! কিন্তু আমাদের লেখা আজও, পঞ্চাশ বছর হয়ে গেল, বলুক কেউ, ওই
ধরণের লেখা আর কোথায় হচ্ছে? এখনও কেউ হাংরিদের লেখা নিয়ে এগিয়ে যাক না!
বারণ তো করছে না কেউ! তখনকার সাহিত্যসমাজ আমাদের চেপে রাখার চেষ্টা করেছিল,
যাতে আমাদের লেখা কারোর হাতে না পড়ে, কেউ জানতে না পারে যে এইধরণের
আন্দোলন হয়েছে। কিন্তু পড়েছে। লুকিয়ে হলেও।
প্রশ্ন – নিষিদ্ধ শব্দের সমাহার ও নিষিদ্ধ উত্তেজনা পাওয়ার ট্রেন্ড থেকেই কি লুকিয়ে পড়ার প্রবণতা আসছে তাহলে?
সুবিমল বসাক – তাহলে তো সমস্ত সংস্কৃত সাহিত্যকেই ফেলে দিতে হয়!
তা নয়। লোকের মনে একটা কনসেপ্ট তৈরি হয়ে গেছে যে, হাংরিদের লেখা মানেই
কয়েকটা গালাগাল, কয়েকটা অশ্লীল শব্দ থাকবেই। ফলে পরিস্থিতিও এরকম
দাঁড়িয়েছে। কিন্তু বাসুদেব দাশগুপ্ত, দেবী রায় এঁদের লেখায় তো অশ্লীল শব্দ
প্রায় নেই বললেই চলে। ওঁরাও তো হাংরি বলেই পরিচিত!
হাংরি জেনারেশনে ক’জন ছিল আর? চার্জশিট হয়েছিল মোটে বারো জনের নামে। এই বারো জনই সমস্ত সাহিত্যটাকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল।
প্রশ্ন – সাহিত্যে যৌনতার প্রসঙ্গ এলেই কি তা নিষিদ্ধ হয়ে যায়?
সুবিমল বসাক – তা কেন হবে? একজন কবি কেন নিজের লেখা ‘নিষিদ্ধ’
মনে করতে যাবে? তাহলে তো সে লিখবেই না! তার কাছে সেটা নিষিদ্ধ নয় বলেই তো
সে লিখেছে। বিনয় মজুমদারের ‘বাল্মীকির কবিতা’র কথায় ধরা যাক। ওগুলো যদি উনি
নিষিদ্ধই মনে করতেন, তাহলে ছাপতে দেবেন কেন? রেখে দিতেন নিজের কাছে!
তখন, ’৬৫ সালে বিতর্ক উঠেছিল, এখন তো সাহিত্য অনেক এগিয়ে গেছে।
মলয় তো যৌনতার ব্যবহার নিয়ে নানাভাবে লিখছে। ভাবাই যায় না, ওভাবেও লেখা
সম্ভব! যৌনতা তো একটা সাবজেক্ট…
প্রশ্ন – কালোত্তীর্ণ সাহিত্য কি হাংরিদের হাত থেকে বেরিয়েছি্ল?
সুবিমল বসাক – কালোত্তীর্ণ কী? কে ওটা তৈরি করেছে, সেটাও তো
বলতে হবে! আন্দোলনের সময় তো আমাদের চেপে রেখেছিল। উঠতে দেয়নি, গালাগাল
দিয়েছিল। নিশ্চই ভয় পেত। নইলে তারা এরকম করবে কেন? বিনয় মজুমদারের বয়েই
গেছে, তিনি সমস্ত খবরের কাগজ’কে লাথি মেরে চলে গেছেন। কিন্তু তিনিও তো লিখে
গেছেন, সেগুলোও কালোত্তীর্ণ হবে, নিশ্চই হবে। শুধুমাত্র খবরের কাগজে
কালোত্তীর্ণ হলেই সব হয় না। কত লেখা পড়ে আছে, অনেক বামপন্থী লেখক ছিলেন,
যাঁদের কোনো সংকলনেই ঢোকানো হয়নি। সেটার বিচার করবে কে? সম্পাদক? এমন অনেক
লেখক আছেন, যারা জীবদ্দশায় পাত্তা না পেলেও পরে লোকে খুঁজে খুঁজে পড়েছে
তাঁদের লেখা।
প্রশ্ন – আপনি হাংরি আন্দোলনের অন্যতম গদ্যকার। আপনার লেখায় যৌনতা কীভাবে ধরা দিয়েছে?
সুবিমল বসাক – সেটা পাঠকই বলতে পারবে। লেখক হিসেবে আমার কাছে
যৌনতার আলাদা কিছু তাৎপর্য নেই। যেমন ডাল-ভাত-জল খাচ্ছি, তেমনি যৌনতাও
এসেছে। যেখানে যেখানে আসার, সেখানেই। তার জন্য আলাদা কোনো প্যারা খরচ করতে
হয়নি আমায়। যৌনতা অনেকে ক্যাপিটাল হিসেবে ব্যবহার করে। আজকালকার সিনেমায়
দেখা যায় সেটা।
‘বিবর’ লেখার জন্য সমরেশ বসু’কে প্রায় বয়কটই করা হয়েছিল। কিন্তু
‘বিবর’ না লিখে ওঁর কোনো উপায় ছিল না। কারন বাংলা সাহিত্য অনেক এগিয়ে
গেছিল হাংরিদের দৌলতে। ওইসময় সেক্স নিয়ে যত হইচই হয়েছিল, এখন কিন্তু তা নয়!
এতটাই স্বাভাবিক হয়ে গেছে সবকিছু।
প্রশ্ন – গত পঞ্চাশ বছরে বাঙালি জাতি এত সহনশীল হয়ে গেল কীভাবে, যাতে সবকিছুই স্বাভাবিক হিসেবে ধরা দিচ্ছে?
সুবিমল বসাক – প্রধান কারণ বিদেশী প্রভাব। এই যে মেয়েরা জিন্স
পড়ছে, টপ পড়ছে, অনেকসময় খোলাই প্রায়; এই বিষয়টা এতই চোখ সয়ে গেছে যে এখন আর
গোপন বলে কিছু নেই প্রায়। অনুসন্ধিৎসা নেই। মেয়েরা নানারকম কথাও বলছে,
পাবলিক প্লেসে, যেগুলো আগে কখনো ভাবাও যেত না। কাজেই আগে মানুষের যে মুখোশ
পরে থাকার ব্যাপারটা ছিল, সেটা ভেঙে গেছে।
প্রশ্ন – মলয় রায়চৌধুরীর ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটি
অশ্লীলতার অভিযোগে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, কবিকে জেলেও যেতে হয়েছিল। আপনার
চোখে কবিতাটি কীভাবে ধরা দিয়েছে?
সুবিমল বসাক – পুলিশ কেস দাখিল করেছিল অশ্লীল শব্দ, বিষয়
ইত্যাদির অভিযোগ দেখিয়ে। শক্তি, সন্দীপন, শৈলেশ্বর, সুভাষ এরা বিরুদ্ধ
সাক্ষ্য দিয়েছিল। আমার এখনও কবিতাটা নিষিদ্ধ মনে হয় না, তখনও হয়নি। সে
সময়কার কবিতার জড়তা’কে একটা আঘাত দিয়েছিল মলয়। ও যে লিখেছে – “কেন আমি
পিতার আত্মমৈথুনের পর তাঁর পেচ্ছাপে বয়ে যাইনি”, এই প্রশ্নটা তো অশ্লীল
কবিতা লেখার উদ্দেশ্যে নয়; ওর নিজের প্রচণ্ড একটা জিজ্ঞাসাই ওকে দিয়ে
লিখিয়েছে। তবু অশ্লীল! এটা সংস্কৃতে লিখলে কিন্তু দারুণ ব্যাপার হত। আর
ইংরাজিতে লিখলে তো কথাই নেই…
প্রাচীন মন্দিরগুলোয় যেসব মিথুনমূর্তি আছে, সেগুলো’কে কী বলা
হবে তাহলে? ভগবান সবই করতে পারে? খাজুরাহো মন্দিরে একটা ন্যুড মূর্তি আছে,
সেটার বিশিষ্ট অঙ্গে হাত বুলোতে বুলোতে কালো করে দিয়েছে সবাই।
প্রশ্ন – আপনি কি আপনার লেখালিখি পরিবারের সঙ্গেও শেয়ার করে নিতে সমান সাবলীল?
সুবিমল বসাক – তাদের মন কীভাবে গড়ে উঠেছে সেটা তাদের ব্যাপার।
আমার লেখা, আমার মন কীভাবে গড়ে উঠেছে সেটা আমার ব্যাপার। তাদের ইচ্ছে হলে
পড়বে, না হলে পড়বে না। পরিণত বয়সে কারোর ওপর কিছু চাপিয়ে দেওয়া ঠিক নয়।
(‘আঙ্গিক’ পত্রিকায় প্রকাশিত)