বৃহস্পতিবার, ৯ আগস্ট, ২০১৮

মলয় রায়চৌধুরী : যখন সুবিমল বসাকের সঙ্গে চামউকুন বাছতুম

 

যখন সুবিমল বসাকের সঙ্গে চামউকুন বাছতুম
মলয় রায়চৌধুরী
ষাটের এলিট বাঙালি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে সুবিমল বসাক আবির্ভূত হয়েছিলেন কাউন্টারকালচারাল একজন সাবঅলটার্ন লেখক হিসাবে । নবারুণ ভট্টাচার্যের মতন তিনি অন্য মানুষদের জীবন থেকে অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করেননি, করেছেন নিজের নিম্নবর্ণ-নিম্নবর্গ জীবনের লাৎ খাবার অভিজ্ঞতা থেকে । সুবিমলের বর্গে শৈশবে গায়ে চামউকুন হয়, চুলে জট পড়ে, নখে ময়লা জমে, ময়লা নখ নিয়েই ভাত-ডাল মাখতে হয়, রাস্তার কলে স্নান করতে হয়, দেনার দায়ে বাপ আত্মহত্যা করলে কৈশোর থেকে সংসার চালাতে হয় । তাই মধ্যবিত্ত জীবনে পৌঁছেও এলিটদের সংস্কৃতিতে ঢোকার অনুমতি পান না সুবিমল বসাক । আসলে, যে বিদ্যায়তনিক আলোচক এলিট সংস্কৃতির প্রডাক্ট, তিনি তাঁর দোসরদের খোঁজ করেন পাল্প ফিকশানে, কেননা প্রতিষ্ঠানের ছত্রছায়া ছাড়া পাল্প ফিকশান শেকড় পায় না ।


উকুন জানতুম, চুলে হয়, বলতে গেলে দেখা যায় না, মাথার চুলে খুঁজে-খুঁজে বের করে টিপে মারতে হয়, বাঁদরদের মতন । ব্যাংকশাল কোর্টে মামলার সময়ে, রাতের বেলায় সুবিমল বসাকের জ্যাঠামশায়ের বইঠকখানার স্যাকরার প্রায়ান্ধকার দোকানঘরে মাদুরে শুয়েছিলুম, সুবিমল বলল, শালা, তোমার গায়ে চামউকুন হয়ে গেছে । সুবিমল আমার গা থেকে ছোটো ছারপোকার মাপের একটা চামউকুন তুলে বলল, পনেরোদিন স্নান করোনি, আদালতের পাবলিকদের সঙ্গে ওঠাবসা করছ, গায়ে চামউকুন হয়ে গেছে, বিহারিদের মতন  । সত্যিই, ফৌজদারি আদালতে এতো রকমের ক্রিমিনাল জড়ো হতো যে সাবধানে না থাকলে খোস-পাঁচড়া, আর নানা ছোঁয়াচে রোগও হয়ে যেতে পারতো । কলকাতায় মাথা গোঁজার ঠাঁই না থাকায় দিনের পর দিন স্নান হতো না ; ততোদিনে চামউকুনরা নিজেদের বংশবৃদ্ধি করে ফেলতো আমার গায়ে ।


হাংরি আন্দোলন মামলার সময়ে কলকাতায় রাতের বেলায় যেখানে হোক মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজতে হতো ; সুবিমল বসাকের জ্যাঠামশায়ের স্যাকরার দোকান ছিল লাস্ট রিসর্ট । রিসর্ট !! চামউকুন বাছার রিসর্ট । ওর এক আত্মীয়ের বাড়ির দালানে মাদুরে শুয়ে রাত কাটিয়েছি । ওই পাড়ায় কোথাও ওর ব্যর্থ প্রেমের নায়িকা থাকতেন ।


চামউকুন যে কেমনতরো উকুন, তা অন্য হাংরি আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছিলুম, কখনও দেখেনি । একটা চামউকুন মেরে কাগজে মুড়ে সুভাষ ঘোষ আর বাসুদেব দাশগুপ্তকে দেখিয়েছিলুম । বাসুদেব তখন বেবি-দীপ্তি-মীরার রেগুলার খদ্দের । সেই পাড়াতেও কারোর গায়ে চামউকুন দেখেনি ।


সুবিমল বসাক পাটনাতেই থাকতো, গান্ধি ময়দানের ওই পারে, পশ্চিম দিকে, গোলঘর নামে ব্রিটিশদের তৈরি একশো চুয়াল্লিশ পাকানো সিঁড়ির ঢাউস খামারবাড়ির কাছে ; গিন্সবার্গকে নিয়ে উঠেছিলুম ওই খামারবাড়ির টঙে, নেমে ভেতরে ঢুকে গিন্সবার্গ ওর  ‘সানফ্লাওয়ার সূত্র’ কবিতা চেঁচিয়ে আবৃত্তি করার পর আফশোষ করেছিল যে একটা রেকর্ডার আনা উচিত ছিল ।


পাটনায় থাকলেও সুবিমল বসাকের সঙ্গে আমার আলাপ ছিল না ; ও পড়তো পশ্চিমের কোনো স্কুলে আর আমি পূর্বদিকের রামমোহন রায় সেমিনারিতে । তবে ওদের পরিবারের কথা বাবা জানতেন ; বলেছিলেন যে ওর বাবা নাইট্রিক অ্যাসিড খেয়ে দেনার দায়ে আত্মহত্যা করেছিলেন । কারোর বাবা আত্মহত্যা করলে তাঁর ছেলের মনে কেমন প্রতিক্রিয়া হয় ? কে জানে, আমার পক্ষে ভেবে ওঠা কঠিন । আমার খুড়তুতো বোন পুটি কড়িকাঠ থেকে ঝুলে আত্মহত্যা করেছিল বাছুরের গলা থেকে দড়ি খুলে ।


‘দুরুক্ষী গলি’ নামে একটা উপন্যাস লিখেছে সুবিমল, ওর আত্মজীবনী, তাতে সোনার গয়না যে কতো ধরণের হতো আর তাদের বিস্ময়কর নাম ছিল, তা ওর ‘দুরুক্ষী গলি’ পড়ে জানা যায় । আমার মনে হয় এটা ওর সেরা উপন্যস, ধরা পড়ে আর্থসাংস্কৃতিক আর ঐতিহাসিক যুগলক্ষণ, আর সেই সঙ্গে বিলুপ্ত হতে-থাকা আত্মনির্ভর স্যাকরাদের ইতিহাসও বটে । পুঁজিবাদী স্বার্থের নিরিখে যখন সাহিত্যিকদের খ্যাতি বিবেচিত হচ্ছে, তখন বঙ্গসংস্কৃতিতে হঠাৎ ঢুকে পড়া ব্যাণ্টামওয়েট মুষ্ঠিযোদ্ধার আদলে ময়লা এক যুবক নিজের লেখালিখিকে নিয়ে গিয়েছে কলোনিয়াল ইসথেটিক রিয়্যালিটির বাইরে ।


সুবিমল পাটনা থেকে কলকাতায় চাকরি করতে গিয়েছিল বলে জানতো যে এখানে মাথা গোঁজার ঠাঁই না থাকলে রাতে কতো বিপদে পড়তে হয় । অন্য হাংরি আন্দোলনকারীরাও অনেকে কলকাতার বাইরে থেকে পৌঁছেছিল, কিন্তু কেউই রাতের বেলায় থাকতে দিতে রাজি হয়নি, নানা অজুহাত দেখিয়ে কাটিয়ে দিয়েছে ।


কলকাতায় হাংরি আন্দোলনের খবর পেয়ে সুবিমল বসাক জানতে পেরেছিল যে বুলেটিন ছাপাবার ইংরেজি ম্যাটার আর টাকাকড়ি আমিই দিই, তাই ১৯৬৩ সালের কোনো এক সময়ে আমার সঙ্গে পাটনায় দেখা করতে এসেছিল, আন্দোলনে যোগ দেবার উদ্দেশে । একদিক থেকে ভালোই হলো, ভেবেছিলুম, ঠিকই ভেবেছিলুম, কেননা চাষি পরিবারের হারাধন ধাড়া তখন নিজের পিতৃদত্ত নাম নিয়ে হিমশিম, এফিডেভিট করে দেবী রায় হবার নির্ণয় নিয়ে ফেলেছে ।


ঢাকার তাঁতি পরিবারের সুবিমল বসাকের নিম্নবর্গ নিয়ে তেমন মনোভাব ছিল না, যখন কিনা ওর বাবা স্যাকরা ছিলেন । দেবী রায় যেমন থাকতো হাওড়ার বস্তিতে, সুবিমল বসাকের বাড়ি গিয়ে দেখলুম, ওদের বাড়িও নিম্নবর্গ বিহারি এলাকায়, আর বাবা না থাকায়, একটা আধখেঁচড়া বাড়িতে বসবাস করে ওকেই ভাইদের বড়ো করে তুলতে হচ্ছে । কলকাতায় ট্রান্সফার নিয়ে চলে গিয়েছিল সাহিত্যের আকর্ষণে । কিছুকাল আগে নিম্নবর্গের জন্য নির্ধারিত একটা পুরস্কারও পেয়েছে সুবিমল । অনুবাদের জন্য সাহিত্য অ্যাকাডেমির পুরস্কার পেয়েছে ।


সুবিমল কাজ করতো ইনকামট্যাক্স দপতরে, সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউতে । ও স্কেচ আঁকতে পারতো, উড-কাট করতে পারতো । তখন এসট্যাবলিশমেন্টের কর্তাদের ‘দয়া করে মুখোশ খুলে ফেলুন’ ছাপানো রাক্ষস জীবজন্তু ইত্যাদির মুখোশ, হাংরি আন্দোলনের পক্ষ থেকে বিলি করা সারা হয়ে গেছে, বিয়ের কার্ডে ‘Fuck the bastards of Gangshalik school of poetry’ ছাপিয়ে বিদ্যায়তনিক কবিদের পাঠানো হয়ে গেছে, কলকাতার মালিকরা ব্লাস্ট ফারনেসে টগবগ করে ফুটছে, সুবিমল বলল যে, ও এবার নানারকম স্কেচ এঁকে স্টেনসিলে একশো কপি ছাপিয়ে বিলি করবে, হাংরি আন্দোলনের নতুন ধরনের বুলেটিন । আমি একটা চার্ট তৈরি করেছিলুম, উনিশ নম্বর হাংরি বুলেটিন হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল, তার স্টেনসিলও সুবিমল তৈরি করে দিয়েছিল । চার্টে দেখানো হয়েছিল যে বাঙালি কবিদের পূর্বপুরুষরা কবিয়াল ছিলেন ; পূর্বপুরুষরা সকলেই নিম্নবর্ণের ছিলেন বলে আধুনিক কবিরা বেশ চটে ছিলেন ।


মজার ছিল বুলেটিনগুলো, মধ্যবিত্ত কবি-লেখকদের ওয়াটারশেডের ওপর থেকে ঠেলে ফেলার জন্য যুৎসই । কয়েকটা মনে আছে : একজন তরুণীর সারা শরীর জুড়ে স্তন, একজোড়া পায়ের স্কেচ যা দেখলেই টের পাওয়া যায় যে মানুষ-মানুষী মিশনারি আঙ্গিকে ছিল, সামনা-সামনি যুবক-যুবতী যা দেখে মনে হবে ফুলদানি, এরকম বহু বুলেটিন, সপ্তাহে একটা করে। নিজের বইয়ের আর ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ পত্রিকার প্রচ্ছদও নিজেই আঁকতো সুবিমল । কেবল ওর ‘ছাতামাথা’ বইয়ের প্রচ্ছদ আমি পেপার কাটিং দিয়ে তৈরি করে দিয়েছিলুম । ‘ছাতামাথা’ বইয়ের উৎসর্গপত্রের আইডিয়াটাও দিয়েছিলুম ।


সংবাদপত্র দপতরে গিয়ে ব্ল্যাংক কাগজকে ছোটোগল্প হিসাবে জমা দেয়া আর রিভিউ করার জন্য বাচ্চাদের চটির বাক্স ব্রাউন কাগজে মুড়ে জমা দেবার ব্যাপারে সুবিমলও গিয়েছিল আমার সঙ্গে । এর জন্য শক্তি চট্টোপাধ্যায় খচে কাঁইবিচি, সাঙ্গোপাঙ্গোদের নিয়ে আমাকে আর সুবিমলকে প্যাঁদাবার জন্য কফিহাউসের বাইরে অপেক্ষা করছিলেন । কফিহাউসের সিঁড়ির কাছে ইসমাইলের পান-সিগারেটের দোকানে লোহার রড লুকিয়ে রাখা হয়েছিল মার দেবার জন্য ।  নিচে নামতেই প্যাঁদাবার জন্য ঘিরে ধরা হয় । সুবিমল সেসময়ে ব্যাণ্টাম ওয়েট বক্সার, হুমকি দিয়ে তেড়ে ভোজপুরি গালমন্দ করতেই সব দেদ্দৌড়, যারা ঘিরে ধরেছিল তারা তো বটেই, শৈলেশ্বর ঘোষ, বাসুদেব দাশগুপ্ত, সুভাষ ঘোষরাও । পরে জানা গিয়েছিল যে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় যেমন আয়ওয়া থেকে হুমকিচিঠি পেয়েছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা, তেমনই পেয়েছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায় - উনি তখন সবে সহসম্পাদকের চাকরির অফার পেয়েছেন ।


পশ্চিমবাংলায় সেই সময়ে রিফিউজিরা সোভিয়েত দেশে বাংলায় অনুবাদ করা মার্কস-এঙ্গেলস পড়ে-পড়ে বামপন্হী হবার দৌড়ে শামিল । বাসুদেব দাশগুপ্ত, সুভাষ ঘোষ আর অরুণেশ ঘোষও বই পড়ে ঢুকেছিল জমায়েতে, সবায়ের দেখাদেখি । পরে ওদের বক্তব্য ছিল যে মফসসলে বেঁচে থাকতে হলে এছাড়া উপায় ছিল না । ওদের বক্তব্যে যুক্তি ছিল, কেননা প্রমোদ দাশগুপ্ত ক্যাডার পাঠিয়ে স্কুলগুলো আর ক্লাবগুলো স্ট্যালিনি কায়দায় দখল করছিলেন । পরে তারা ইংরেজির এমন পেছন মেরে দিল যে পশ্চিমবঙ্গ থেকে ইউপিএসসির পরীক্ষাগুলোয় কেউই প্রতিযোগীতা করতে পারে না, দলে-দলে পালিয়েছে-পালাচ্ছে বাইরের রাজ্যে বা বিদেশে ।


বই পড়ে যা হয়, বামপন্হীরা জোটবেঁধে নিজেদের আখের গুছিয়ে আর্থিকভাবে প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগীতায় মাতলো আর বামপন্হাকে ডোবালো । সুবিমল বসাক ওই সব বই পড়াপড়ির দিকে যায়নি, ওর আগ্রহ হয়নি, নিজের জীবনে যতো লাৎ খেয়েছিল, ওর দরকার ছিল না বই পড়ে সেসব জানা-বোঝার । লাৎগুলো ও প্রয়োগ করেছে ওর লেখায়, কবিতা-গল্প-উপন্যাসে । মনে রাখা দরকার যে সুবিমল যখন লেখালিখি আরম্ভ করে, তখন কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর সাহিত্যিকরা দল বেঁধে নিজেদের প্রতিষ্ঠানের অনুগামী করে তুলেছিলেন ।


সুবিমল বসাক ‘ছাতামাথা’ নামে একটা ফিকশানে হাত দিলো, হাংরি আন্দোলনের ডামাডোলের মাঝেই, যেখানে সুযোগ পেতো লিখতে বসে যেতো । আমি আইডিয়া দিয়েছিলুম যে আমরা যেহেতু এসট্যাবলিশমেন্টের লিটেরারি ভ্যালুজকে রিভার্স করে দিচ্ছি, ‘ছাতামাথা’ ফিকশানের সংলাপ লেখো কলকাতার বুলিতে আর ন্যারেটিভ লেখো ঢাকার কুট্টিদের বুলিতে । কুট্টিদের বুলি নিয়ে সুবিমল প্রায়ই রগড় করতো । ‘আর্ট ফর আর্ট সেক’ এর ধরতাইকে ছিৎরে লাট করে দিয়েছিল ‘ছাতামাথা’, প্রধানত ট্রান্সকালচারালাইজেশনের বিরুদ্ধে স্হানিকতাকে প্রয়োগ করে ।


এখন বাংলাদেশে একটা বিদ্যায়তনিক ধুয়ো উঠেছে যে কলকাতার ভাষা বর্জন করে বাংলাদেশের কথ্যবুলিকে ভাষার পর্যায়ে উন্নীত করা হোক, তাইতে সাহিত্য রচিত হোক, অথচ যখন আমি ওনাদের বলি যে সুবিমল বসাক অলরেডি এই কাজ পাঁচ দশক আগে করে ফেলেছেন, তখন ব্রাত্য রাইসু আর সলিমুল্লা খানরা  কানে তুলো দিয়ে থাকেন । সুবিমল বসাকের গদ্য আর পদ্য কাল্পনিক নিম্নবর্গীয় নয় । প্রতীকি নয়, তা রিয়্যাল ফ্লেশ অ্যান্ড ব্লাড । খোলনলচে পালটে ফেলার জন্য যতো ধরণের টেকনিক সম্ভব, ব্যবহার করেছে সুবিমল । তাকে যদি কোনো আলোচক অ্যানার্কিক বলে তকমা দেন, তাহলে তাই সই ।


নকশাল আন্দোলনের ঠিক আগে বেলঘরিয়ায় জমি কিনে সুবিমল নিজের আস্তানা গড়ে ফেলল, চারিদিকে সুনসান, তখনও বাড়িঘর তেমন হয়নি, সেখানে হাংরি আন্দোলনকারীরা জমায়েত হবার নিরিবিলি খুঁজে পেলো । ফালগুনী রায়, ত্রিদিব মিত্র আর ওর প্রেমিকা আলো মিত্র, করুণানিধান মুখোপাধ্যায়, অনিল করঞ্জাই, কাঞ্চন মুখোপাধ্যায় আর বিদেশ থেকে যারা আসতো, যেমন ট্রেশম গ্রেগ, ডেভিড গারসিয়া, জর্জ ডাউডেন, নেপালি কবি পারিজাত যিনি আমার প্রেমে পড়েছিলেন এবং যাঁকে নিয়ে আমি বেশ কিছু প্রেমের কবিতা লিখেছিলুম ।


নকশাল আন্দোলনের সময়ে সুবিমল বসাকের বাড়ির সামনে প্রায়ই গোষ্ঠী-খুনোখুনি হতো, পুলিশও লাশ হাপিশ করার অন্ধকার খুঁজে পেতো । সুভাষ ঘোষ কিছুদিন ওর আস্তানায় ছিল আর সুবিমলের কাছে হাংরি আন্দোলন সম্পর্কিত যে কাটিঙের ফাইল ছিল তা নিয়ে শৈলেশ্বর ঘোষের শালা সুভাষ কুণ্ডুকে দিয়েছিল । অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ফাইল ছিল সেটা, হাংরি আন্দোলনের সমস্ত কাটিঙ সংগ্রহ করে হাইকোর্টের ব্যারিস্টার করুণাশঙ্কর রায়কে দিয়েছিলুম । বহু সংবাদপত্রে আমার আর অনেক সময়ে আমার আর দেবী রায়ের কার্টুন প্রকাশিত হয়েছিল, হাংরি আন্দোলনের গবেষকদের কাজে লাগতো । সুভাষ ঘোষের আত্মীয় ছিল সুভাষ কুণ্ডু, শৈলেশ্বর ঘোষের শালা হবার সূত্রে।


সুবিমল বসাক ওর রিভার্স ন্যারেটিভ টেকনিক বজায় রেখে কবিতা লিখল পূর্ববঙ্গের বুলিতে, অথচ সেগুলো কেন নজর কাড়লো না বলা কঠিন, কেননা আইরিশ ভাষায় সিমাস হিনির লেখা কবিতা ইংরেজি পত্রিকায় নিয়মিত আলোচিত হয়েছে । সুবিমল ছোটোগল্প লেখা আরম্ভ করল কলকাতাবাসী অবাঙালি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে, তাদের কথাবার্তায় যে বদল ঘটে গেছে তা প্রতিফলিত হলো ওর গদ্যে । বহুকাল অবহেলিত ছিল ওর বইগুলো । এখন তন্ময় ভট্টাচার্যের উদ্যোগে সৃষ্টিসুখ থেকে সেগুলো খণ্ডে-খণ্ডে প্রকাশিত হচ্ছে । সুবিমল বসাক ওর মায়ের কাছ থেকে আর বৃদ্ধা আত্মীয়দের বাড়িতে গিয়ে ‘ঢাকাই বিয়ার গীত’ সংগ্রহ করে প্রকাশ করেছিল । একটা ‘কুসংস্কার সংকলন’ও প্রকাশ করেছিল ।


হাংরি আন্দোলন মামলার সময়ে সুবিমল বসাকই শেষ পর্যন্ত আমার সঙ্গে ছিল । ওর অফিস থেকে চলে আসতো ব্যাংকশাল কোর্টে, আমার মামলার ডেট পড়লে । সুবো আচার্য, প্রদীপ চৌধুরী, শৈলেশ্বর ঘোষ, বাসুদেব দাশগুপ্ত সব হাওয়া হয়ে গিয়েছিল । আমি পাটনায় গেলে সুবিমল আমার উকিলদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতো । হাইকোর্টের জুনিয়ার ব্যারিস্টার করুণাশঙ্কর রায়ের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতো । হাইকোর্টে আমি মামলা জিতে গেলে সুবিমলই কোর্ট থেকে রায়ের কপি নিয়ে আমাকে পাঠিয়েছিল পাটনায় ।


তবে সুবিমলের একটা ধারণা ভুল । নব্বুই দশকে আমি আমার কলকাতা অফিসে বিভাগীয় প্রধান হয়ে ফেরার পর শৈলেশ্বর, সুভাষ, প্রদীপের সঙ্গে দেখা করেছিলুম । সুবিমলের সঙ্গেও । তাকে সুবিমল ভেবেছিল আমি হাংরি আন্দোলন রিভাইভ করতে চাইছি । আসলে আমি যে ইতিমধ্যে প্রচুর পড়াশুনা করে ফেলেছি, ভারতের বহু গ্রামে ঘোরাঘুরি করে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি, তার হদিশ পায়নি সুবিমল । যাই হোক, আমার নতুন লেখালিখি নিয়ে এক সাক্ষাৎকারে সুবিমল নিজেই বলেছে যে আমার লেখার ধরন আর ভাবনাচিন্তা পুরো পালটে গেছে ।


‘ছিটেফোঁটা’ পত্রিকার বইমেলা ২০১০ সুবিমল বসাক সম্বর্ধনা সংখ্যায় কলিম খান এই কথাগুলো সুবিমল বসাক সম্পর্কে লিখেছিলেন, যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ :
“আধুনিকতাবাদী, অ্যাকাডেমিশিয়ান, প্রগতিপন্হি, কমিউনিস্ট-সাম্যবাদী, মৌলবাদী, হাংরি, উগ্রপন্হী... বহু রকম মানুষই আমরা চারিদিকে দেখতে পাই; এবং তাঁদের নেতৃস্হানীয়রা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অত্যন্ত স্বাতন্ত্র্যাভিমানী।স্বাতন্ত্র্যের অভিমানের মধ্যে সকলের থাকে বিশেষ হওয়ার, পৃথক হওয়ার প্রবণতা থাকে। তথাকথিত সাম্যবাদীদের মধ্যে তো স্বাতন্ত্র্যের অভিমান সবচেয়ে বেশি, যদিও স্বাতন্ত্র্য সাধারণভাবে বিশেষবাদী বা অসাম্যবাদী। বিপরীতে দেখা যায়, গ্রামবাংলার মানুষের মধ্যে, তথাকথিত ধর্মভিরু সাধারণ মানুষদের মধ্যে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের অভিমান সবচেয়ে কম। তাঁদের ভিতরে সকলের থেকে পৃথক বা আলাদা হয়ে থাকার কোনো প্রবণতা দেখা যায় না, বিপরীতে মিলে-জুলে থাকার প্রবণতা দেখা যায়। বাংলা ভাষার শব্দার্থতত্বের বিচারে এরকম মানুষদেরই 'সুন্দর' মানুষ বলতে হয়। সেই হিসেবে শ্রী সুবিমল বসাকও সুন্দর মানুষ।


১৯৯৬ সালে তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে। বিগতকালের হাংরি আন্দোলনের এক বিদগ্ধ আত্মারূপেই আমি তাঁকে চিনেছিলাম। একালের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যাবাদী সমাজে সকল সামাজিক সত্তার ও প্রতিষ্ঠানাদির যেমন কেন্দ্র ও প্রান্ত হয়ে থাকে, হাংরি আন্দোলনেও সেইরূপ কেন্দ্র-প্রান্ত ব্যাপার ছিল। কেন্দ্রে যখন মলয় রায়চৌধুরী সগৌরবে বিরাজিত ছিলেন, তখন প্রান্তে ছিলেন সুবিমল বসাক। কালধর্ম তাঁকে যে-কলঙ্ক বা গৌরব দিয়েছিল, তা সবই তখন মলিন হয়ে এসেছিল। তাঁর স্বভাবের মধ্যে সেসবের রং-রূপ, তেজ-ছটা আমার চোখে খুব একটা পড়েনি। যেটি পড়েছিল, তা হল তাঁর নিষ্কলুষ আত্মার দীপ্তি। প্রথম আলাপেই বুঝেছিলাম, এই মানুষটির সঙ্গে নির্বিবাদে ঘর করা চলে।


কলকাতার বাংলা সাহিত্যের জগতে আমার অনুপ্রবেশ ঘটে ১৯৯৫ সালে। ১৯৯৭-৯৮ সালের মধ্যেই আমি টের পেয়ে যাই, এই জগৎ অত্যন্ত কলুষিত হয়ে গেছে। ভাল সাহিত্যিক তো পরের ব্যাপার, আগে তো ভাল মানুষের সাক্ষাৎ পেতে হবে। এখানে যে ভাল মানুষের দেখা মেলা অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে! কার্যত আজকের কলকাতায় বঙ্গসাহিত্যের সারস্বত ব্রহ্মলোকে ভালমানুষের দেখা পাওয়া ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠেছে। যাঁরা মানিষ হিসেবেই কলুষিত, তাঁরা ভাল সাহিত্যিক হবেন, এমন আশা করা খুবই ত্রুটিপূর্ণ এবং দুরাশা মাত্র। তারই মাঝে যে আমি দু'চারজনকে ভালো মানুষ রূপে পাই, তাঁদেরই একজন শ্রী সুবিমল বসাক। ২০০০ সাল থেকে আমি সেমিনার, সাহিত্যসভা ইত্যাদিতে যাতায়াত বন্ধ করে দিই এবং অনেকের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে দিয়ে একান্তে নিজের কাজ করতে থাকি। সেই একান্ত সময়েও যাঁদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক কমবেশি অক্ষুণ্ণ থাকে, শ্রী সুবিমল বসাক তাঁদের একজন। তাঁর সান্নিধ্য আমার খুবই ভাল লাগত। তাঁর ভালমানিষির গন্ধ মনেপ্রাণে মাখামাখি হয়ে যেত। মনে পড়ত সৈয়দ মুজতবা আলীর সেই অমোঘ বাণী --- 'কয়লাওলার সাথে দোস্তি, ময়লা হতে রেহাই নাই/ আতরওলার বাক্স বন্ধ, দিল খুশ তবু পাই খুশবাই।' শ্রী সুবিমল বসাকের সাহিত্যসৃষ্টি নিয়ে আমার কিছু বলার নেই। কেননা, তাঁর সাহিত্য আমার মস্তিষ্কের স্বভাবের সঙ্গে খাপ খায়নি বলে তা আমার উপভোগ্য হয়নি। অতএব, যা আমি ভাল করে উপভোগ করিনি, তা রসাল ও সুস্বাদু কি না, বলদায়ক কি না, উপাদেয় কি না, তা নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে আমি পারব না। কিন্তু মানুষটি যে আমার খুবই আপনজন রূপে গৃহীত হয়েছিলেন, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। তাঁকে আমি 'সুন্দর মানুষ' বলেই চিনেছিলাম, চিনেছি, ভালবেসেছি।”


সুবিমলের ‘’হাবিজাবি’ কবিতা দিয়ে চামউকুন পর্ব শেষ করছি :-


আমারে মাইরা ফেলনের এউগা ষড়যন্ত্র হইসে
চারো কোনা দিয়া ফুসফুস আওয়াজ কানে আহে
ছাওয়াগুলান সইরা যায় হুমকে থিক্যা
অরা আমারে এক্কেরে শ্যায করতে সায়
আমি নিজের ডাকাইতে্ যা হাতেরে লইয়া সচেত্তন আসি
কেউ আইয়া চ্যারায় দিশায় চ্যাবা কথা কয় না
আমি সুপসাপ থাকি
ভালাসির গুছাইয়া আমি কথা কইতে পারি না
২ কইতে গিয়া সাত হইয়া পড়ে
১৫ সাইলে ৯ আইয়া হাজির হয়
ছ্যাব ফেলনের লাইগ্যা বিচড়াইতাসি অহন
আহ, আমার দাঁত মাজনের বুরুশ পাইতাসি না
বিশ্বাস করেন, কেউ একজনা আমার মুহের সকরা খাবার খাইসে ।
(হাংরি বুলেটিন নং ১৮ থেকে)

বৃহস্পতিবার, ৩ মে, ২০১৮

সুবিমল বসাক ও তাঁর লেখালিখি : তন্ময় ভট্টাচার্য

সুবিমল বসাক ও তাঁর লেখালিখি : তন্ময় ভট্টাচার্য

                                                                    

তাঁর লেখা অনেকেই পড়েনি। কিন্তু যারা পড়েছে, ভুলতে পারেনি। তিনি সুবিমল বসাক। বাংলা সাহিত্যের ব্যাতিক্রমী গদ্যকারদের প্রথম সারিতেই উঠে আসা উচিৎ তাঁর নাম। অথচ, প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা যথেষ্ট হলেও, মূলত প্রচারের অভাব, দুষ্প্রাপ্যতা ও প্রকাশকের প্রকাশকের উদ্যোগহীনতার কারণে তাঁর বেশিরভাগ বই-ই গরিষ্ঠ সংখ্যক পাঠকের অপঠিত থেকে গেছে আজ পর্যন্ত। ভবিষ্যতের জন্য বইগুলি বাঁচিয়ে রাখা একান্ত প্রয়োজন; নইলে বাংলা সাহিত্যের কিছু দুর্মূল্য রত্ন আড়ালে চলে যাবে চিরদিনের জন্য…

(১)
১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৩৯ সালে বিহারের পাটনায় জন্মগ্রহণ করেন সুবিমল বসাক। কিন্তু আদতে তাঁর শিকড় পূর্ববঙ্গের ঢাকায়। একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন – “বাবা যৌবনে ঢাকা ছেড়ে আসেন, কাজের ধান্দায় নানান জায়গায় ঘুরে শেষে পাটনায় থিতু হন। ভাল কারিগর ছিলেন, উদ্যমী ছিলেন, পরিশ্রমীও ছিলেন। প্রচুর অর্থ উপার্জনের সঙ্গে সঙ্গে অভিজাত মহলেও একটা আসন গড়ে তুলেছিলেন। পাটনায় দোতলা বাড়ি নির্মাণ করেন ১৯৩৯ সালে, আমার জন্মবর্ষে, কিন্তু গৃহপ্রবেশ করেছিলেন কয়েকবছর পর; কেননা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্বে জনৈক মিলিটারি অফিসার আমাদের বাড়িতে ঢুকে পড়েন। মা-কে ঢাকা থেকে নিয়ে আসার পর পাটনার স্থায়ী বাসিন্দা। আমাদের স্বজাতি অন্যান্য ব্যবসায়ীর তুলনায় আমাদের অবস্থা খুব উন্নত ছিল বলা যায়। পরিবারের অন্যান্যরা ঢাকায় থাকতেন, যৌথ পরিবারের দরুণ বাবাকে নিয়মিত খরচ পাঠাতে হতো। আমার মামার বাড়িও ঢাকায়, তখন বিয়ের সম্বন্ধ হতো কাছে পিঠে। পরে অবশ্য এক মামা আর মেসো খাগড়ায় স্থায়ী বাসিন্দা হন। মামাতো ভাই-বোনেরা খাগড়াই ভাষায় কথা বলে। ঢাকায় আমরা শেষ যাই পঞ্চাশ সনের কিছু আগে, পাসপোর্ট-ভিসার প্রচলন হয়নি, তখনও ভারতীয় টাকা চলতো – নোটের বাঁ-দিকে সাদা অংশে ‘গভর্নমেন্ট অফ পাকিস্থান’ ছাপা থাকতো, ডানদিকে ষষ্ঠ জর্জ। পঞ্চাশের দাঙ্গায় আত্মীয়-স্বজন সকলেই বাড়ি জমি, স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ফেলে রেখে চলে আসে। রিফ্যুজি কার্ড হোল্ডার। আমরা অবশ্য সে অর্থে রিফ্যুজি নই, কিন্তু অবস্থা খারাপ ছিল রিফ্যুজি-আত্মীয়দের চেয়েও…”। তাঁর পিতা ছিলেন গহনার দোকানের মালিক। যথেষ্ট স্বচ্ছ্বল অবস্থা থাকা সত্ত্বেও, ১৯৬৩ সালে ভারত সরকার কর্তৃক ‘গোল্ড কন্ট্রোল’ আইনের ফলে অনেক ব্যবসায়ীর সঙ্গে তিনিও আর্থিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েন এবং নাইট্রিক অ্যাসিড খেয়ে আত্মহত্যা করেন। 

পাটনায় মলয় রায়চৌধুরী, সমীর রায়চৌধুরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও দেবী রায়ের নেতৃত্বে ১৯৬০ সালে শুরু হয় হাংরি আন্দোলন। বাংলা সাহিত্যের তথাকথিত সংরক্ষণশীল মানসিকতা ভেঙে নতুন পথের সূচনা করাই ছিল আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য। মলয় রায়চৌধুরীর সঙ্গে আলাপের সুবাদে, পিতার মৃত্যুর পর, ১৯৬৩ সালের শেষের দিকে সুবিমল বসাক যোগ দেন হাংরি আন্দোলনে। তাঁর শক্তিশালী কবিতা ও গদ্যের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন এবং সমান্তরালভাবে চক্ষুশূল হন বাংলা সাহিত্যের অধিপতিদের। পাটনা থেকে আগত সাবঅল্টার্ন শ্রেণীর একজন বাংলা সাহিত্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে – এ তাঁরা সহ্য করতে পারেননি। সুবিমল বসাক তখন ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ নামের একটি লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনা করতেন। সেই পত্রিকার এক সংখ্যায় শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের একটি কবিতা ছিল। ‘দেশ’ পত্রিকার সম্পাদক সাগরময় ঘোষ শক্তি’র ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন, হাংরি পত্রিকায় লেখা দেয়ার জন্য। ফলে সুবিমল বসাকের ওপর শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের আক্রোশ জন্মায় এবং একদিন কলেজ স্ট্রিট কফি হাউজের নিচে সুবিমল বসাক’কে দলবল সহ ঘিরে ধরে শক্তি লোহার রড দিয়ে মারতে উদ্যত হন। সে সময় সেই চত্ত্বরে উপস্থিত ছিলেন দেবী রায়, ত্রিদিব মিত্র, বেলাল চৌধুরী প্রমুখ। তাঁদের তৎপরতায় ঝামেলা বেশিদূর গড়ায়নি। এ সব ঘটনা এখন কিংবদন্তী। অশ্লীলতার দায়ে হাংরি জেনারেশনের যে পত্রিকাটি বাজেয়াপ্ত হয়েছিল, তাতে সকলের সঙ্গে সুবিমল বসাকেরও লেখা ছিল এবং যে এগারোজনের বিরুদ্ধে সাহিত্যে অবসিনিটির জন্য আদালতে মামলা দাখিল করা হয়, তাঁদের মধ্যে সুবিমল বসাক একজন। পরবর্তীকালে ১৯৬৫তে আন্দোলন সমাপ্ত হলে আন্দোলনকারীরা পরস্পরের থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন হয়ে যান এবং ব্যক্তিগত লেখালিখির ধারা বজায় রাখেন।

সুবিমল বসাকের প্রথম গ্রন্থ ‘ছাতামাথা’, ১৯৬৫ সালে প্রকাশিত। তাঁর অন্যান্য বই – হাবিজাবি(১৯৭০), গেরিলা আক্রোশ(১৯৭৪), আত্মার শান্তি দু’মিনিট(১৯৮৫), অযথা খিটক্যাল(১৯৮৭), বিয়ার গীত ও ঢাকাই ছড়া(১৯৮৭), কুসংস্কার ১৫৫(১৯৮৭), প্রত্নবীজ(১৯৯৬), ক্যাজুয়াল লিভ(২০০০), বকবকানি(২০০০), এথি(২০০১), কুট্টি(২০০৩), তিজোরীর ভিতর তিজোরী(২০০৫), গোপন দস্তাবেজ ও শীততাপ নিয়ন্ত্রিত আত্মা(২০০৭), দুরুক্ষী গলি(২০১১), এখনও কোনো ব্যবস্থা হয়নি(২০১৪)। এর মধ্যে ‘হাবিজাবি’ ও ‘বকবকানি’ এ দুটি কবিতা সংকলন। 

সুবিমল বসাক বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান অনুবাদক। তাঁর অনুদিত গ্রন্থগুলি হল – প্রতিবেশী জানালা(কবিতা সংকলন, ১৯৭৫), তিসরী কসম(ফণীশ্বর নাথ রেণু, ১৯৭৬), পঞ্চপরমেশ্বর(প্রেমচন্দের গল্প সংকলন, ১৯৮০), ফণীশ্বর নাথ রেণু’র শ্রেষ্ঠ গল্প(১৯৮২), দুই সখী(প্রেমচন্দের গল্প সংকলন, ১৯৮৪), জীবন সার(প্রেমচন্দের প্রবন্ধ, ১৯৮৫), উজ্জয়িনীর রাস্তা(শ্রীকান্ত বার্মার কবিতা সংকলন, ১৯৮৬), বোবাদের পল্লীতে(জগদীশ চতুর্বেদীর কবিতা সংকলন, ১৯৮৯), খুবসুরত(খাজা আহমদ আব্বাসের গল্প সংকলন, ১৯৯২), গোমুখ যাত্রা(শীলা শর্মা’র ভ্রমণকাহিনী, ১৯৯২), মোহন রাকেশ(প্রতিভা অগ্রবাল রচিত জীবনী, ১৯৯৩), হিন্দী কাহিনী সংগ্রহ(১৯৯৯), আমার তোমার তার কথা(যশপালের উপন্যাস, ২০০১), যাত্রিক(নীল পদ্মনাভন, ২০০২)। 

ওপরে ২০১৫ পর্যন্ত প্রকাশিত বইগুলির নামই উল্লেখ করা হয়েছে। ২০১৬ কলকাতায় বইমেলায় প্রকাশিত হবে সুবিমল বসাকের রচনা সংকলনের প্রথম খণ্ড(ছাতামাথা, গেরিলা আক্রোশ, আত্মার শান্তি দু’মিনিট ও অযথা খিটক্যাল), শাবানা আজমির ‘আব্বা’ বইটির অনুবাদ।

 সুবিমল বসাক যশপালের হিন্দী উপন্যাস ‘মেরি তেরি উসকি বাত’ বাংলায় অনুবাদের জন্য ২০০৭ সালে সাহিত্য আকাদেমি পুরষ্কার অর্জন করেন।

(২)
বেলঘরিয়ার ইতিহাস প্রসঙ্গে সুবিমল বসাকের কথা লিখছি কেন? ওঁর জন্ম তো পাটনায়, শিকড় পূর্ববঙ্গের ঢাকায়, তাহলে? উত্তর খোঁজা যাক সুবিমল বসাকের এক সাক্ষাৎকারেই – “বেলঘরিয়ায় আমি আসি ১৯৬৭ সালে। তার আগে অনেক আস্তানা বদল করে ডানলপ ব্রিজের কাছাকাছি অশোকগড়ে একটা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতাম। …অশোকগড়ের বাসা ছেড়ে বেলঘরিয়ায় চলে আসি। প্ল্যাটফর্মে ঘরখালি বিজ্ঞাপন দেখে স্টেশনের ধারে যে পাড়া পাই, বিবেকানন্দ নগর বস্তি-কাম-পাড়া তাতে বাসা নিই। তখনও জানা ছিল না, পাড়াটা বিহারের তুলনাতেও একটি ভয়ঙ্কর জায়গা। আশেপাশে স্বাধীনতা-উত্তর ওয়াগন ব্রেকার, চুল্লুঠেক এবং খুনেদের সমাহার। যে ঘরটায় আমি থাকতাম, তার উত্তরে খোলা মাঠ, এবং ওই মাঠে যে বহু লাশ গুম করা হত সেটা পরে টের পাই। রাতবিরেতে মাতালদের হল্লা, পুলিশের যখন-তখন আস্ফালন এবং ওয়াগন ব্রেকারদের রাজত্ব বিস্তার।” ১৯৮০ সালে বিবেকানন্দ নগরের ভাড়াবাড়ি ছেড়ে বেলঘরিয়ার ভার্নার লেনে নিজস্ব বাড়ি তৈরি করে স্থানান্তরিত হন তিনি এবং এখনও ভার্নার লেনের ওই বাড়িতেই বাস করেন। সাহিত্য অনুরাগীদের কাছে দীর্ঘদিন ধরে বেলঘরিয়ানামটি উজ্জ্বল হয়ে আছে সুবিমল বসাকের বসবাসের সৌজন্যেই, কেন না এখনও পর্যন্ত তাঁর মাপের কোনো সাহিত্যিকের দীর্ঘ সংস্পর্শধন্য হয়নি এই জনপদ। তাই, পাটনায় জন্ম হলেও, বেলঘরিয়ার সঙ্গে প্রায় পঞ্চাশ বছরের সম্পর্ক যে মানুষটির, তাঁকে অস্বীকার করলে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে কি?

সুবিমল বসাক বেশ কিছু কবিতা লিখলেও তাঁর পরিচয় মূলত গদ্যকার ও অনুবাদক হিসেবে। তাঁর সাহিত্যকীর্তি নিয়ে আলোচনার জন্য একটি অধ্যায় যথেষ্ট নয়। সম্পূর্ণ একটি গ্রন্থ রচিত হওয়া উচিৎ শুধুমাত্র লেখার বিষয় ও ভাষার ভঙ্গি নিয়েই। এখানে সামান্য আভাস দিয়ে রাখি মাত্র…
তাঁর প্রথম গ্রন্থ ছাতামাথাবাংলার প্রথম ডি-ন্যারেটিভাইজড উপন্যাস। গতানুগতিক সূত্র ধরে ঘটনাপ্রবাহে এগিয়ে যাওয়ার সম্পূর্ণ বিপরীতে দাঁড়িয়ে এই সৃষ্টি। ঢাকার কথ্যভাষায় লেখা এই উপন্যাস শুরু হচ্ছে এইভাবে – “আন্ধার আর সুমসাম কুঠুরিতে একলা থাকলেই আমার খালি খালি নরক আর শয়তানের কথা মনে আহে। নরক যাওনের রাস্তাঘাটগুলা চিনা নাই, চিনাজানা থাকলে মাঝেমধ্যি আওন-যাওন যাইতো। পূজা-পাইলের দিনে তেহার-পরবে ঐহানে গিয়ে দুই একদিনের লাইগ্যা ঘুইর‍্যা আওন যাইতো। … হয়তানের কথা হগল সময়ে মনে আহে, অর কথা ভাইব্যা-ভাইব্যা শরীল নিপাত করি, অথচো কোন কুলকিনারা পাই না। ক্যান জানি মনে হয়, হয়তানে আমার কাছে পিঠেই আছে। …যারে দেহি তারেই জিগাই, ‘এখানে শ্রীযুক্ত বাবু শয়তান নামে কেউ থাকেন কি?’” বইটির উৎসর্গপত্র বাংলা সাহিত্যে আজও মৌলিক। এমনটি আর কেউ লিখতে পারেননি। ষাটের দশকে বইটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই বাংলার এলিট সাহিত্যমহলে তীব্র সাড়া পড়ে গিয়েছিল গদ্যের ফর্মের জন্য। 

‘হাবিজাবি’ বইটির সব কবিতাই ঢাকাই ভাষায় রচিত। যে কারণে অনেকের বোধগম্য না হলেও, যারা ধৈর্য ধরে সেই বেড়াটুকু টপকে যেতে পেরেছে, বাংলা কবিতার এক নতুন ফর্ম উঠে এসেছে তাদের কাছে, যে ফর্মের ধারেকাছে পঞ্চাশ বছর বাদে আজও কেউ দাঁড়াতে পারেনি। একটি কবিতা তুলে ধরি –

সারারাত্র বাত্তি আঙাইয়া আমি আর উই শুইয়া কাটাই
নীল হেজহানে লাগালাগি চাম ছেঁওয়াইয়াও কতো আল্‌গা আছি
অর চ্যারায় কুনো পীরিতের চিন্‌হী নাই
আমার চ্যারায়ও কুনো পীরিতের চিন্‌হী নাই
ভয়ান্নক রূপ দেহনের ডরে আমরা দুইজনে চোক্ষু জুইব্বা আছি
তবও নিষ্ঠুরের লেহান আওগাইয়া
কয় দণ্ড মুহূর্ত
কিছুটা সময়-ওক্তো
আমরা
পীরিতের খেলা-পীরিতের খেলাখেলি।


লক্ষ্য করবেন, ভাষার আড়ালে জীবনের কী দুর্বিষহ সহনশীলতার কথা উঠে এসেছে কবিতায়। এমনই আরেকটি ‘বকবকানি’ গ্রন্থের ‘জন্মদিনে’ কবিতাটি –

জন্মদিনে ওড়ানো আটটি সাদা পায়রা, আজ
ফিরে আসে ঊনষাটটি কালো শকুন
চাতালহীন মাথার ওপর তাদের যূথবদ্ধ
অবিশ্রান্ত ওড়াউড়ি
জটিল ও বিশৃঙ্খল ছায়া
দুর্বোধ্য ও পারম্পর্যহীন চিৎকার
আমার সমস্ত মন দূষিত করে তোলে
জানা ছিল না
কী বিশাল রোমশ কালো দাঁত
ছড়ানো চারদিকে
বারবার হড়কে পড়ি কোন এক অদৃশ্য টানে
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে ওঠে দুঃখ-যন্ত্রণা

আজ, আমার মায়ের ঝকঝকে কণ্ঠস্বরও
ধূসর হয়ে পড়ে!


কোনটা ছেড়ে কোনটার কথা বলি! ‘গেরিলা আক্রোশ’, ‘অযথা খিটক্যাল’, ‘আত্মার শান্তি দু’মিনিট’, ‘গোপন দস্তাবেজ ও শীততাপ নিয়ন্ত্রিত আত্মা’, ‘এখনও কোনো ব্যবস্থা হয়নি – প্রত্যেকটিই গদ্যগ্রন্থ হিসেবে ব্যাতিক্রমী এবং সুবিমল বসাকের কলমের মুনশিয়ানার চূড়ান্ত পরিচয় পাওয়া যায় এগুলিতে। সাবঅল্টার্ন অর্থাৎ সমাজের অন্ত্যজ শ্রেণীর লোকেদের কথা তাঁর লেখায় উঠে এসেছে বারবার, তিনি নিজেও সেই সমাজের মধ্যে দীর্ঘদিন বাস করায়, প্রাণবন্ত হয়েছে উপস্থাপনা। এই নজির দেখা যায় বিশেষত ‘প্রত্নবীজ’-‘এথি’-‘তিজোরীর ভিতর তিজোরী’ – এই ত্রয়ী’তে। পাটনায় অবস্থিত বিহারীদের মুখে বাংলা’র যে উচ্চারণ, সেই ভাষায় রচিত এই তিনটি বই বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। পটভূমিকাও বিহারের। সতীনাথ ভাদুড়ী ছাড়া আর কেউ বাংলায় এ ধরণের লেখায় সফল হয়েছেন কিনা, জানা নেই। সুবিমল বসাক ‘এথি’ ভাষাতেও প্রকাশ করেন, ‘মহল্লা লোদীপুর’ নামে; এবং বইটি বিহারে দারুণ সমাদৃত হয়। লেখক নিজেও বিশ্বাস করেন, তাঁর ‘প্রত্নবীজ’ বইটি একদিন সমাদৃত হবেই বাংলার পাঠকসমাজে। 

১৯৮৭ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর একটি অনন্যসাধারণ গবেষণাগ্রন্থ – ‘বিয়ার গীত ঢাকাই ছড়া’। লেখক তাঁর এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন – বিয়ার গীত সংগ্রহ করাটা ছিল অন্যপথে। জনৈক স্বজাতির বিয়েতে হাজির হয়ে দেখেছি, কয়েকজন প্রৌঢ়া-বৃদ্ধা তাঁদের শেষ কামড় দিচ্ছে। আমি সংগ্রহ করতে শুরু করি। নদীয়া-ফুলিয়া অঞ্চলে গিয়ে কিছু সংগ্রহ করেছি। এই রীতি-নীতি, গীত, পদ এখন লোপ পেয়েছে বলা চলে। মীজানুর রহমান বিয়ার গীত প্রাপ্তিস্বীকারে লিখেছিলেন – ‘এই বিরাট মাপের কাজটি আমাদেরই করার কথা, আপনি কাজটি করে আমাদের স্মৃতি উসকে দিয়েছেন। বাংলাদেশে প্রত্যন্ত এলাকায় এখন মাইকেল জ্যাকসন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। মীজানুর রহমান তাঁর পত্রিকায় পুরো বইটি ছেপেছেনবইটির প্রথম অংশ ‘বিয়ার গীত’। এখানে লেখক ঢাকার হিন্দুদের বিবাহের আচার-আচরণ, নিয়ম ও তৎসংলগ্ন গানের বর্ণনা দিয়েছেন। ঢাকায় প্রচলিত বিয়ে উপলক্ষে গানকে বিয়ার গীতবলা হয়কেবল ঢাকা নয়, সমগ্র ঢাকা জেলায় বিয়ার গীতবলে প্রচলিত… এইসব গানে তখনকার কাল যুগ পরিবেশ ইত্যাদির একটা মোটামুটি আভাস পাওয়া যায়, তখনকার সময়ের সহজ সরল অনাড়ম্বর অনুভূতির রেশ এই সব বিয়ার গীতে উপস্থিত থাকে। হারিয়ে যাওয়া সংস্কৃতির শেষ অস্তিস্ত্বটুকু লেখক অমর করে রেখেছেন তাঁর এই গ্রন্থে। বইটির দ্বিতীয় অংশে আছে প্রচুর ছড়া, যা ঢাকার অধিবাসীদের মুখে মুখে পরম্পরায় প্রচলিত। সেসব স্মৃতিমেদুরতায় ভারাতুর, অনায়াসে হাত ধরে নিয়ে যায় শৈশবে। দুঃখ হয় যখন দেখি, বাংলার তথাকথিত সংস্কৃতিমনস্ক মানুষেরা বইটির সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন আদৌ।
‘কুসংস্কার ১৫৫’ বইটিতে সংকলিত আছে বাংলায় প্রচলিত ১৫৫টি কুসংস্কার; যা সুবিমল বসাক দীর্ঘ অনুসন্ধানের মাধ্যমে সংগ্রহ করেছিলেন। ‘কুট্টি’ হল ঢাকার গাড়োয়ানদের মুখে মুখে প্রচলিত রসিকতার এক অনবদ্য সংকলন। অবাক লাগে, পারিপার্শ্বের যথাযোগ্য সহযোগিতা না পেয়েও তিনি কীভাবে লিখে গেছেন একের পর এক বই। সমান্তরালভাবে বেরিয়েছে অনুদিত গ্রন্থগুলিও। তাঁর স্মরণযোগ্য একটি উপন্যাস ‘দুরুক্ষী গলি’, এবং উপন্যাস হিসেবে হয়তো সর্বোত্তমও। চলিত বাংলায় লেখা হলেও বইটির পরতে পরতে মিশে আছে ফেলে আসা ঢাকা’র স্মৃতি। অভিজ্ঞতা ছাড়া এমন উপন্যাস লেখা যায় না। মলয় রায়চৌধুরী আমাদের একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, এই উপন্যাসটি লেখকের সেরা রচনা; এমন বিষয় নিয়ে আগে কেউ লেখেনি, পরেও কেউ লিখবে না সম্ভবত। স্বর্ণকারদের দৈনন্দিন জীবন ও জীবিকার এমন সূক্ষ্ম বর্ণনা অভিজ্ঞতা ছাড়া লেখা অসম্ভব। এবং ঘটনাপ্রবাহে আকর্ষণীয় করে তোলাও একটি শিল্প। বহুকাল আগে মুর্শিদাবাদ থেকে একদল তাঁতি ইংরেজদের অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে পূর্ববঙ্গে পালিয়ে গেছিলেন, বিশেষত ঢাকায়। সেখানে স্বর্ণকারবৃত্তি’কেই তাঁরা জীবিকা হিসেবে বেছে নেন। তারপর, গত শতকের চল্লিশের দশকে অনেকেই পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন, দেশভাগের পূর্বাভাস পেয়ে। তাঁদের কয়েকজন বিহারের পাটনায় স্বর্ণকারের জীবিকা বজায় রাখেন। তাঁরাই উপন্যাসের নায়ক। সময়ের হাত ধরে এই উপন্যাসে উঠে এসেছে দেশভাগ, ঢাকা’র স্মৃতি, বিবাহের রীতি, কৈশোরের অনুভূতি, যৌনতার স্বাদ। এবং পরিসমাপ্তি চীন-ভারত যুদ্ধের আঙিনায়। বাংলা সাহিত্যে সম্ভবত আর কোনো উপন্যাসে ৬১’সালের চীন-ভারত যুদ্ধের পটভূমিকা আসেনি। ‘দুরুক্ষী গলি’ হল পাটনার প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি রাস্তা, যেখানে স্বর্ণকারদের বাস। তাঁদের আচারে কল্পনায় যাপনে উঠে আসে ঢাকা’র ফেলে আসা দিনগুলো। যে কারণে তারা বলে ওঠে – “খালি কলমের আঁচড় কাটল – ওমতে দেশভাগ। আমগো লগে থাকতে হইলে এই দ্যাশে আসতে হইব। হ। আরে, লোকজনের কত কষ্ট, কত দুর্দশা, কত ছিদরত, বাড়িঘর সাত পুরুষের ভিটা ছাইড়্যা, চিরদিনের মতো চইল্যা আসন কি মুখের কথা! নাড়ির টান পড়ে” সম্পূর্ণ সাবঅল্টার্ন অবস্থান থেকে লেখা এই উপন্যাসের পরিণতিতে অস্তিত্বের সংকট কী করুণভাবে বর্ণিত হয়েছে তা সত্যিই দেখার মতো। একবার ঢাকা থেকে উচ্ছেদ হলেও যেসব লোকেরা নিজেদের জীবিকা ত্যাগ করেনি, ভারত সরকারের ‘গোল্ড কন্ট্রোল’ আইনের ঠেলায় তাদের আত্মপরিচিতি কিভাবে অভাবের সঙ্গে সঙ্গে বিলুপ্ত হয়ে গেল – সেই বাস্তবের এক মর্মন্তুদ দলিল এই উপন্যাস।

 সুবিমল বসাক হলেন সেই সাহিত্যিক, যিনি হাংরি আন্দোলনের সময়কাল থেকে এখনও সমান সক্রিয় এবং সৃষ্টির অদম্য তাড়নায় লিখে যাচ্ছেন আজও। অসংখ্য গল্প, কবিতা ও প্রবন্ধ এখনও গ্রন্থিত হয়নি। প্রকাশিত বইগুলিও দুস্প্রাপ্য। আমাদের দেশে ফ্লিমস্টারদের খ্যাতি আকাশচুম্বী, অথচ সুবিমল বসাকের মতো একজন সাহিত্যিক নূন্যতম সম্মানটুকুও পান না সমাজ থেকে। কেন? তথাকথিত নামী প্রকাশনা থেকে তাঁর বই এখনও বেরোয়নি বলে? মানুষটি প্রচারবিমুখ বলে? না আমাদেরই উদ্যমের অভাব ও সংকীর্ণ মানসিকতা? আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ভীষণ প্রয়োজনীয় প্রশ্ন এটি।

(‘বেলঘরিয়ার ইতিহাস সন্ধানে’ বই থেকে)




সুবিমল বসাকের 'গেরিলা আক্রোশ' -একটি অবচেতনার দলিল : তন্ময় ভট্টাচার্য

সুবিমল বসাকের ‘গেরিলা আক্রোশ’ – একটি অবচেতনার দলিল : তন্ময় ভট্টাচার্য

“জন্মসূত্রে পাওয়া আতঙ্ক ভয় ত্রাস – যা থেকে মানুষের নিস্তার নেই – লক্ষলক্ষ শ্বেত কপোত উজ্জ্বল আলো স্কাইক্র্যাপার্স পরিকল্পনা রাজনৈতিক রাডার সোনালী ভবিষ্যৎ কিছুই এই অন্তর্নিহিত সংকট থেকে উদ্ধার করতে পারেনি – মানুষকে অনায়াসে ঢূকে পড়তে হয় এক অদৃশ্য ঘেরাটোপে – যার সেলোটেপ সরাতে গিয়ে আঙুল দুমড়ে শীর্ণ হয়ে আসে শিরদাঁড়া বেঁকে নুয়ে পড়ে – তবুও ঐ শীর্ণ আঙুলে ভাঙা শরীরে প্রতিরোধ চালিয়ে যায় – স্বাধীনতাকামী মানুষ – তার আক্রোশ -” এই হলো বইটির উপজীব্য। সুবিমল বসাক হাংরি আন্দোলনের একজন সামনের সারির সৈনিক যার কলমে ফুটে উঠেছে সামাজিক তথা মানসিক বিপন্নতার সুচারু চিত্র। এমনই পাঁচটি গদ্যের সংকলন ‘গেরিলা আক্রোশ’। প্রকাশকাল ১৯৭৪। এতদিন পর গ্রন্থটির সমালোচনা করা কিছুটা ধৃষ্টতা তো বটেই,  কারণ কালের স্বাভাবিক নিয়মে একশ্রেণীর উৎসাহী পাঠকের কাছে সমাদৃতও হয়েছে বইটি। তবু সম্পূর্ণ অন্য ধারার এই গদ্য সংকলনটির স্বাদ আরও বৃহত্তর ক্ষেত্রে পৌঁছে দেয়ার জন্যেই এই প্রয়াস।

প্রথম গদ্যটির নাম ‘গেরিলা আক্রোশ’। লেখকের যৌবনোচিত মানসিক অস্থিরতার কথা ফুটে উঠেছে এতে। প্রধান উপাদান একটি ডাইরি ও একটি বেতারযন্ত্র। ডাইরির পাতা উল্টাতে ভয় করে তাঁর, কেননা তখনই “বুকের ভেতর রক্ত তোলপাড় শুরু করে দেয়। ঘরের একপাশ অন্ধকারে ছেয়ে থাকে, বাতি জ্বালাতে গিয়ে আলো বেরোয় না।” বিভিন্ন প্রতিকূল অভিজ্ঞতায় জর্জরিত লেখক ডাইরির কাছে এসে নিছক স্মৃতির আক্রমণের ভয়েই অবচেতনে গড়ে তোলেন বিরূপতা। আর তার থেকে মুক্তি পেতে বেতারযন্ত্রের শরণাপন্ন হন তিনি, এবং সেই বেতারেও জন্মাবধি তাঁর সমস্ত ইতিহাস ও অভিজ্ঞতা ধ্বনিত হতে থাকে। অসহায় লেখক স্বস্তি পান বেতার থামার সঙ্গে, এবং তিনি শেষ পর্যন্ত আবার ফিরে আসেন ডাইরির কাছেই। সব মিলিয়ে এক আশ্চর্য জীবন ও মনের ছবি খুঁজে পাই এই গদ্যটিতে যার পরতে পরতে মিশে আছে শান্তির জন্য হাহাকার।

দ্বিতীয় গদ্য ‘আগ্রাসী অপকর্ম’। লেখকের চারপাশে অজস্র শব্দ এবং সেই শব্দের কাছে ধরাশায়ী তিনি। শয়নে স্বপনে জাগরণে বিভিন্ন শব্দ ও তার অশান্ত ফল চাবুকের মতো তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় লেখক-কে, কিন্তু শব্দহীন সেই স্থান অধরাই থেকে যায়। এমনকি ঘড়ির মধ্যে থেকেও লেখক শুনতে পান এক গম্ভীর কন্ঠস্বর – “পৃথিবীর প্রতিটি পিতা তার পুত্রকে পুরুষ বন্ধুর সঙ্গে এবং কন্যাকে মহিলা বন্ধুর সঙ্গে মিশতে দিচ্ছে।” শব্দের পীড়ন লেখককে আতঙ্কিত করে তোলে। রেডিয়ো’র নব ঘোরাতেই দুম্‌ ক’রে ঘোষিত হয় – “জন্ম-মুহূর্তে কেউ নবজাত শিশুর মুখের দিকে চেয়ে দেখে না।” শব্দ তোলপাড় হতে থাকে। এমনকি ‘মগজে প্রতিরোধহীন টুপটুপ রক্ত চুঁইতে থাকে’, টেপরেকর্ডার শুনিয়ে যায় জাম্পকাট ঘটনাবলী – অসহ্য একঘেয়েমির শেষ হয় ফিতে ছিঁড়ে গেলে। তখন পুনরায় অন্যান্য শব্দ জোরদার হয়ে ওঠে। “কানের কাছে বিশৃঙ্খল পারম্পর্যহীন শব্দাবলীর প্রতি মন রেখে বুঝতে পারি, আজীবন এই গাদাগাদা শব্দের মরণাক্রমণ আমাকে সহ্য করতে হবে। তা থেকে আমার নিস্তার নেই, কেননা মৃত্যুই শব্দহীনতা”। এই শাশ্বত উপলব্ধির কাছে নতজানু হয়ে এবং অসহায়তার কাছে আত্মসমর্পণ করেই শেষ হয় লেখকের যাত্রা।

তৃতীয় গদ্যটি হলো ‘হুঁশাহুঁশহীন ছোবল’। অবচেতনের এক অনবদ্য ছবি ফুটে উঠেছে লেখাটিতে। ফাঁকা ঘরে লেখক স্মৃতি হাতড়াতে যখন বুঁদ, দরজার বাইরে এক বিড়ালের ডাকে ঘোর কাটে তাঁর। “ওর চোখদুটো ভয়ানক জীবন্ত দেখায়।…কেমন যেন কুঁকড়ে সিঁটিয়ে পড়ি…এতক্ষণের স্মৃতি চিন্তা ধারণা বাল্যকাল ডাইরি প্রেম ভাবনা সব ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে।” ক্রমশ বিড়ালের অবয়ব পাল্টাতে পাল্টাতে লেখক দেখেন তাঁর মৃত পিতার প্রতিকৃতি। সেটিও বদলে যায় একটি ঝুলন্ত জিভে – গলন্ত সেই জিভ এগিয়ে আসে লেখককে লেহন করতে। মনের পর্দায় একের পর এক ঘটনাপ্রবাহ চলতে থাকে সিনেমার মতো, মধ্যে মধ্যে স্নায়ুতন্ত্রীতে বেজে ওঠে “বাবা এসেছে বাবা এসেছে বাবা এসেছে বাবা এসেছে বাবা এসেছে…”। সমস্ত চিন্তা জট পাকিয়ে যায়। হাল ছেড়ে দিয়ে লেখক বলেন, “এখন দীর্ঘসময় চিন্তা ভয়হীন আমি ঘুমিয়ে থাকতে চাই – জানি, আমার এই ঘুম কখনও ঘটবে না।” দক্ষ শব্দশিল্পী না হলে অবচেতনকে এভাবে ফুটিয়ে তোলা যায় না, আর এখানেই সুবিমল বসাকের সার্থকতা।

“চোখের পাতা নামালেই সেই সেলুলয়েড… আমার শরীর ভারী ও হিম করে তোলে, হাত নাড়াবার মত শক্তি সামর্থ্য হারিয়ে ফেলি। ভিজে কামান নেতিয়ে থাকে হাঁটুর দেয়ালে।”  – চতুর্থ গদ্য ‘অপ্রতিরোধ্য ভাইরাস’-এ বলা আছে স্বপ্নদোষের পর ঘুম ভেঙে-যাওয়া এক যুবকের কথা, অস্বস্তির চরম সীমায় পৌঁছে যে আঁকড়ে ধরতে চায় অরুণিমার শরীর। যুবকটি মন ঘোরানোর জন্য পড়তে শুরু করে একটি প্যানপ্যানে প্রেমের কাহিনী। কিন্তু সেই আপাত-গতানুগতিক কাহিনী পাঠের মধ্যে-মধ্যেও যুবকের স্মৃতিতে ঝলকানি দিয়ে ওঠে আধিভৌতিক দৃশ্যকল্প।  ক্রমশই “অরুণিমার হাঁ ক্রমশ বড়ো হতে হতে ভয়ঙ্কর হয়ে পড়ে… হাত টুক্‌ করে পড়ে যায় বাহুমূল ছিঁড়ে তারপর পা স্তন সব বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে থাকে…”। কাহিনীও এগিয়ে চলে বিয়োগের দিকে, সমান্তরালভাবে যুবকের মানসিক আলোড়নও চরম বিন্দু থেকে ক্রমশ শিথিল হয়ে যায়। বলা বাহুল্য, এখানে যুবকটি লেখক নিজেই।

পঞ্চম ও শেষ গদ্যটি হলো ‘তেজস্ক্রিয় দুঃস্বপ্ন’। এবং সম্ভবতঃ সবচেয়ে তেজস্ক্রিয় গদ্যও এটিই। একটি বাসযাত্রার বর্ণনা, যেখানে লেখক সিট পান জানলার ধারে বসা একটি যুবতীর পাশে। “মেয়েটি সিঁটিয়ে বসে আছে। শাড়ির ভাঁজে সংকোচ ভাব। আমার অস্বস্তিবোধ হতে থাকে। ওর অস্বাভাবিকতার জন্য আরও বেশি বিচলিত বোধ করি।” তারপর বয়সের স্বাভাবিক ধর্মে লেখক ক্রমশ আকৃষ্ট হন যুবতীর প্রতি, বাসের মধ্যেই যুবতীর চোখ বাহু ও স্তনের আভাস তাঁকে উত্তেজিত করে তোলে। “মেয়েটির প্রোফাইলে উজ্জ্বল আয়নার মত ঝকঝকে সিঁদুরে আলো – কিছুক্ষণ একদৃষ্টে চেয়ে থাকলে শিরদাঁড়া শিরশির করে ওঠে।” এরপরই যুবতীর ব্লাউজসিঞ্চিত স্তন ও লেখকের কনুইয়ের ঈষৎ স্পর্শমেদুরতা – এবং কামোদ্দীপনা – হয়তো তা উভয়ার্থেই। কিন্তু হঠাৎই বাসটির মৃদু অ্যাকসিডেন্ট এবং তারপর থেকে লেখকের মানসিকতার চূড়ান্ত মোড় ও চেতন-অবচেতনের নিদারুণ ছলনা গদ্যটিকে অমরত্বের পর্যায়ে নিয়ে যায়। অপূর্ব এই গদ্যটি – যাকে ‘জীবনদর্পণ’ বলতেও কোনো দ্বিধা নেই – বাংলা সাহিত্যের একটি উল্লেখযোগ্য সম্পদ।

সুবিমল বসাক গতানুগতিক লেখকদের থেকে সম্পূর্ণ অন্য পথে হেঁটেও যে কীর্তির নজির রেখেছেন, তাতে তাঁকে অবজ্ঞা করার কোনো উপায়ই নেই। তাঁর ভাষা অননুকরণীয়। আর, ‘গেরিলা আক্রোশ’ বইটি তো যেকোনো যুবকের মানসিকতার এক অত্যুজ্জ্বল প্রতিফলন। সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতার পরিবর্তে মানসিক ক্ষুধা ও অনুভূতিকেই সুবিমল বসাক বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন এই পাঁচটি ভিন্নধর্মী গদ্যে; আর তাই নিঃসন্দেহে বলা যায়, কালের সীমা পেরিয়েও অক্ষুণ্ণ থাকবে ‘গেরিলা আক্রোশ’ ও তার দ্যুতি।

 
   

 
   

সুবিমল বসাকের কবিতা "হলদেটে পাতার আড়ালে" : তন্ময় ভট্টাচার্য

সুবিমল বসাকের কবিতা – হলদেটে পাতার আড়ালে : তন্ময় ভট্টাচার্য

(১)
প্রতি রাত্র
আমার লগে বেইমানি করে ম্যায়ামানুষের লেহান
                          নিখুঁত
ম্যায়ামানুষের লগে
অহন আর কোনো সম্পক্ক নাই আমার
                     তবভি
পুরানা স্মৃতি
আমারে বারবার ছোবল মারতে থাকে
আমি তাগো ভালাবাসি
ভালবাসার গাঢ়ভাব না দেইহা।
                     (হাবিজাবি – ২১)
স্বীকারোক্তির বিভিন্ন ধরণ থাকে। বেশিরভাগই প্রচ্ছন্ন। আমাদের পাঠকমন তাতে হাবুডুবু খায়, ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ গোছের একটা ডিসশানে এসে সুখটান মারে সিগারেটে। এমন অভ্যাসে “আমি তাগো ভালাবাসি/ভালবাসার গাঢ়ভাব না দেইহা” – এসব কথা মুখোশ টেনে ধরে, চচ্চড় করে আঠা, আঁকড়ে রাখতে চাই, ছাল উঠে যায়। স্পষ্ট কথায় কষ্ট আছে তো বটেই! আমরা বাপ-মায়ের আহ্লাইদ্যা পুলা, কবিতা বলতে বুঝি পান্তাভাতের সঙ্গে পেঁয়াজ কামড়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর; সেখানে অনভ্যস্ত পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট আর গ্লিসারিনের বিক্রিয়া আগুন তো জ্বালাবেই! বালিশ তোশক কম্বল চাদর হাতের কাছে যা কিছু পাই তা দিয়ে চেপে ধরি, ছড়িয়ে যায় আরো। জল ঢালি। পোড়া গন্ধ। নাক কুঁচকাই। হো হো করে হেসে ওঠেন সুবিমল বসাক।
এখানেই চুপ করা যেত। কিন্তু ফাঁক গলে ঢুকে পড়ছে সিনিয়ার কণ্ঠস্বর। ঢাকাইয়া ভাষায় হাবিজাবি কিছু লিখলেই সেটা কবিতা হয়ে যাবে? মামদোবাজি নাকি? আমরা এতদিন ধরে ঘষে ঘষে পাছার আদ্ধেক মাংস ক্ষইয়ে মৌরসিপাট্টা দখল করলাম, আর কোথাকার কোন পাটনার ছেলে এসব স্টান্ট দেখিয়ে হাততালি নেবে? শাশ্বত বোঝে? অমরত্ব জানে? আনন্দ ওর বই ছাপিয়েছে? অমুক স্মৃতি পুরষ্কার পেয়েছে? তমুকের বৌয়ের সঙ্গে পার্টিতে ছবি তুলেছে? তাহলে কীসের কবি হে! চেষ্টা করুক, ওরও হবে। হতেই হবে। আমরা আছি না…

(২)
আরশির ওই পাড়ে ফুটছে শয়তানের চ্যারা
ফিরা ফিরা প্রতিশোধ লইতে তেইড়্যা আহে
আমার উল্টাহানই আমি নিত্য দেহি আরশিতে।
                             (হাবিজাবি – ১২)
মেলা বিপদে ফেললেন মশাই! চেপেচুপেই রেখেছিলাম এতদিন! ‘কেটেছে একেলা বিরহের বেলা/আকাশকুসুম চয়নে’ গাইতে গাইতে দিব্যি তো ফুলটুশকুমার আছি; ছিপে যদি মাছ না ওঠে, চালাও পানসি বেলঘরিয়া! ওইসব আয়না-টায়নায় দাঁড়াতে গেলে, বিবেকের গুঁতোয় মাথা মুড়িয়ে সন্নেসী হয়ে যাব যে! হ্যাঁ, আমি জানি আমি শয়তান, মাল্টিপল ডেফিনেশনের সবকটাই অ্যাপ্লাই করা চলে আমার ওপর। তা বলে সুন্দর করে রঙ মেরে রেখেছি যে পরিচয়ে, খুঁড়ে বের করতে যাব কোন দুঃখে? একটা প্রেস্টিজ আছে না? ওসব পাপবোধ-টোধ প্রথমদিকে অনেক হত, এই বুঝি কেউ এসে ছিঁড়ে দেবে সাধুপুরুষামি; ঘুম হত না অনেকদিন। নিজের মুখ নিজেকেই দেখানো যায় না, আয়নায় দাঁড়াবো কীভাবে? আড়চোখে দেখলেও একটা ছোটোলোক কোত্থেকে এসে ভ্যাঙাতে থাকে। চাবকাতে থাকে সারা শরীরে। তবে ভুলেও থাকা যায়। ফুর্তিসে বাঁচো, গুলি মারো ওসব হিস্ট্রিতে। আস্তে আস্তে সব ফিকে হয়ে যাবে।
বাই দ্য ওয়ে, আপনি জানলেন কীভাবে? কবি না গুপ্তচর মশাই?

(৩)
তোমার ওই ব্যবহার-তরিবতে
আলগা-পীরিত ছাপাইয়া ওঠে
     দেহন-মন্তরে সীনার ভীৎরে যন্তন্না টাটায়
আমি আওগাইয়া যাই তোমার লাগ্‌
পুরানা ঘটনা রক্তে অহন বিষের লেহান্‌
সময়েতে ছোবল মারে নীল নীল
তোমার লগে মেল বয়না এতটুক্‌
তবভি আওগাইয়া যাই তোমার লাগ
       ধোন্ধের লেহান কেবল ঘুইর‍্যা মরি।
                             (হাবিজাবি – ১৯)
স্বীকার করুন বা নাই করুন, ল্যাং খাওয়া মানুষ আর ঠ্যাং খোওয়া মুরগির মধ্যে প্রধান পার্থক্য হল ইচ্ছের। মানুষটি অন্ধকার ঘরে হলেও আশায়-আশায় বসে থাকে, কোনোদিন যদি ফিরে আসে! আর মুরগি দুঃখে হতাশায় নিজেকেই তুলে দেয় হত্যাকারীর হাতে। ঝুলে থাকতে কারোরই বিশেষ আপত্তি নেই – একজন আধমরা, অন্যজন পুরোটাই। কিন্তু যেখানে-সেখানে পালক ছড়িয়ে নিজেকে ঘিনঘিনে করে তুলতে পারে না বলেই মানুষ কোনোদিন মুরগি হতে পারবে না। প্রেমিকই থেকে যাবে।
এই যে ‘আলগা-পীরিত’টির কথা সুবিমল বসাক লিখেছেন, লেখেননি নেলপালিশরঙা আঙুলের কথা। দুটো মিলে যে আঁচড়, তাতেই জ্বলে ওঠে পুরুষের যাবতীয় লাগাম-প্রবণতা। বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়, ‘হ্যাঁ, আমিও ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য’। এবং, সত্যি বলতে, ফুল ফল গাছ পাখি চাঁদ তারা নদী ইত্যাদি সবকিছু এই আটফুট-বাই-ছয়ফুট ঘরের মধ্যে উপচে পড়ে। সাঁতার না জেনেও সাঁতরাতে ইচ্ছে করে, চুমু খেতে না জেনেও মনে হয় ইমরান হাসমি তো বাচ্চা ছেলে! আকাশে ঝিলিক মারতে থাকে অসময়ে চোখের বিদ্যুৎ।
এরপর বাজ-পোড়া গাছ। কখন যে ঝলসে গেছেন, বুঝতেই পারবেন না। হাত বাড়াচ্ছেন, ধরার বদলে ঢেলে দিচ্ছে যন্ত্রণার অ্যাসিড। সাধে কি মলয় রায়চৌধুরী বলেছেন – “আজ মনে হয় নারী ও শিল্পের মতো বিশ্বাসঘাতিনী কিছু নেই”! আপনার মনে ফিরে-ফিরে আসবে ফেলে আসা দিনের স্মৃতি, যাকে এত ঘনিষ্ঠ চিনতেন, আপনার উপস্থিতি তার কাছে হয়ে উঠবে বিষময়। তবু আপনাকে যেতেই হবে। বিজ্ঞানের যুগেও এ এক অদ্ভুত নিশিডাক। যাবেন, অপমানিত হবেন, ফিরে আসবেন, আবার যাবেন। সাইক্লিক প্রসেস। ফাইনালি, একদিন মুরগির মতো ঠ্যাং তুলে মরে যাবেন।
এটুকু সান্ত্বনা যেন সেদিনও থাকে যে, আপনি আসলে প্রেমিকই ছিলেন, মুরগি না…

(৪)
সারারাত্র বাত্তি আঙাইয়া আমি আর উই শুইয়া কাটাই
নীল হেজহানে লাগালাগি চাম ছেঁওয়াইয়াও কতো আল্‌গা আছি
অর চ্যারায় কুনো পীরিতের চিন্‌হী নাই
আমার চ্যারায়ও কুনো পীরিতের চিন্‌হী নাই
ভয়ান্নক রূপ দেহনের ডরে আমরা দুইজনে চোক্ষু জুইব্বা আছি
তবও নিষ্ঠুরের লেহান আওগাইয়া
            কয় দণ্ড মুহূর্ত
            কিছুটা সময়-ওক্তো
আমরা ‘পীরিতের খেলা-পীরিতের খেলা’ খেলি।
                               (হাবিজাবি – ৪)

তারপর, পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ি। ভালোবাসা যখন বাধ্যতায় পরিণত হয়, তার থেকে কষ্টকর আর কিছুই নেই। ছেড়ে আসার পথ বন্ধ, কারণ আপনি দায়িত্ব নিয়েছেন; ভুলে যাওয়ার ক্ষেত্রেও আঙুল তোলে শিষ্টাচার। প্রতিবাদ তখনই সফল হয়, যখন পিছুটান ফেলে আসা যায়। আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়েও ঘেন্না নিয়ে বেঁচে থাকি বলেই আমরা সংসারী। আমরা অসহায়। পূর্বনির্দেশিত বেশ কিছু নিয়মের মধ্যে একটা হল অপরকে তৃপ্ত করা। মনের খবর ক’জনই বা রাখে! শরীরে শরীর লেগে আগুন জ্বলে ওঠাই যেন সাম্যবাদের শ্রেষ্ঠ সাফল্য। বিশ্বাস করুন, আমি-আপনি তখন একটা যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই নই। ওয়েল্ডিং মেশিনের সঙ্গে আমাদের কোনো পার্থক্যই নেই।
ভালোবাসাহীন এই মিলনে মরে যেতে যেতে আর কতদিন সামাজিকতার পরীক্ষা দিতে হবে, বলতে পারেন?

(৫)
২৬নং রাস্তার চৌমাথায় আইয়া দেহি
             ম্যায়ামানুষ খাড়াইয়া আছে সটান
শরীল লইয়া আওগাইয়া আহে, পুরুষের হুম্‌কে
আমি আঙুলের ইশারা করতেই খোলস্‌ ছিড়্যা বাইরইয়া পড়ে লাল ফুল
সোন্দর পাপড়ি ছিড়্যা দাঁতে চাবাইয়া দেহি,
               অহন আর কুনো সোয়াদ পাই না
গাড়ীর লামাৎ কেউ চাপা পড়লেও অস্‌থির হই না
এই শহরের নিশ্বাসে আমার কইল্‌জা পুইড়্যা গেছে
আন্ধারে কেবল বিড়ালের লাল চক্ষু জ্বল জ্বল করে
                                   (হাবিজাবি – ২৩)

টইটম্বুর হয়ে আছেন। একটা টোকা মারলেই ফুটপাথ ভেসে যাবে বিরক্তিতে। সিগারেট খেয়ে খেয়ে মুখের ভেতরটা পানসে। চুমু খেতে চাইছেন কি? সাবধান! বিষ যখন অমৃতের বেশে ধরা দেয়, তার থেকে বিপজ্জনক আর কিছুই হতে পারে না। হাতছানি। শক্ত হচ্ছেন। কাছে এগিয়ে এল। শক্ত। আহ্বান। ঝাঁপালেন। আবার বিরক্তির শুরু…
কোথায় যাওয়া যায় বলুন দিকি? মর্গের দেয়াল ছেয়ে গেছে সিনেমার পোস্টারে। থানার বাইরে পাবলিক টয়লেট। মন্দিরের চাতালে জুয়ার আড্ডা। ন্যাংটো ছেলে পুরুষ হতে চাইছে। ফুটপাথে ঘন্টা থাকে না। সাইরেন। কোথায় পালাবেন? মৃত্যু এখন জলভাত। খালাসিটোলা? বড্ডো ভিড়। একা হতে চাই। আপনিও কি? চলে আসুন তাহলে আমাদের একমেবাদ্বিতীয়ম কুঠুরিতে। যেখানে জয়েন্ট মানে শুধুই পরীক্ষা নয়। চোখ লাল হলে অন্ধকারের ভয় দেখাবে না কেউ। নরম গদির পাশে একট পিকদানি ও একটা তবলচি পেলে আপনিই আজ রাতের নবাব।
মুজরোর চিন্তা নেই। তিলোত্তমা ঘাঘরা ওড়াতে পারে ভালো…


কাব্যগ্রন্থ – হাবিজাবি
কবি – সুবিমল বসাক
প্রথম প্রকাশ – ১৯৭০
রচনাকাল – ১৯৬৩-৬৮





 

 
   





সুবিমল বসাকের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তন্ময় ভট্টাচার্য

সুবিমল বসাকের মুখোমুখি তন্ময় ভট্টাচার্য

 প্রশ্ন – সাহিত্যে নিষিদ্ধতা বলতে আপনি কী বোঝেন?

সুবিমল বসাক – সাহিত্য আমরা দু’ভাবে দেখি – একটা সিদ্ধ, একটা নিষিদ্ধ। সিদ্ধ মানে যেটা চলে আসছে কোনো বাধা ছাড়াই, আর নিষিদ্ধ মানে যেটা সহজভাবে কেউ গ্রহণ করছে না। আমাদের মামলা-মোকদ্দমার সময় জেনেছি, হাইকোর্টে ‘নিষিদ্ধ’ বলতে ঠিক কী বোঝায়। এমন বহু শব্দ আছে, যেগুলো সকলের সামনে উচ্চারণ করা যায় না। অবসিনিটি বা নিষিদ্ধতা শুধু লেখার ওপরেই নয়; ছবি, দৃশ্য সবকিছু মিলিয়েই। সকলের সঙ্গে, গোটা পরিবারের সঙ্গে বসে দেখা যায় না এমন দৃশ্য। যেগুলি শরীর, মন, চেতনা সব মিলিয়ে অদ্ভুতভাবে নাড়া দেয়। সেই নাড়া’টা নিশ্চই ভালো নয়, তাই সেটা নিষিদ্ধ হয়েছে। ‘নিষিদ্ধ’ বলতে, এককথায়, যেটার সম্মুখীন আমরা সচরাচর হই না। এই ব্যাপারটা পূর্বপুরুষেরা আমাদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছেন। সচরাচর কোনো কথা, কোনো ব্যবহার, কোনো বিষয়, কোনো পরিবেশ যখন দেখি আমাদের সংস্কারের সঙ্গে মিলছে না, তখন সেটাকে নিষিদ্ধ বলি। কিন্তু কবিতায় বা গদ্যের কোনো শব্দ, যেটাকে বলা হচ্ছে অশ্লীল, অথচ যেটা জীবনের সত্য, সেইসব শব্দের ব্যবহার আগেকার যুগে যে চলেনি তা নয়; সংস্কৃত সাহিত্যে দেখা যেত, কিন্তু সেটা ছিল অনেক ওপরতলার ব্যাপার; অর্থাৎ আগে সংস্কৃত পড়তে হত, তার অর্থ বুঝতে হত। কিন্তু এখন বাংলায় লিখলে, লোকে যেহেতু পড়তে পারে, বুঝতে পারে, সেই কারণে নিষিদ্ধ ব্যাপারটাকে চিহ্নিত করে নেয় তাদের মতো করে।
একটা লেখা যখন সাহিত্যে উত্তীর্ণ হয়, তাতে শ্লীল-অশ্লীল কোনো ব্যাপারই নয়। তখন সাহিত্য ওপরে উঠে আসে, বাকি বিষয়গুলো চলে যায় বাইরে।

প্রশ্ন – হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে অনেকের ধারণা, মূলবোধহীন কয়েকটি যুবক শুধুমাত্র নাম কেনার উদ্দেশ্যে লেখায় ভালগারিটি নিয়ে এসেছিল। সত্যিই কি তাই?

সুবিমল বসাক – যে সাহিত্যধারাটা চলে আসছিল, তার বিরুদ্ধে একটা ধাক্কা দেয়ার দরকার ছিল। সেটাই আমরা করেছি। কিন্তু নাম কামাবার কোনো ব্যাপার ছিল না। আসলে আমাদের আগেকার লোকেরা কিছুটা হয়তো আমাদের চেপে রাখতে চেয়েছিল। তাই এইসব প্রচার।

প্রশ্ন – হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে আপনারা যদি যুক্ত না থাকতেন, তাহলে আজ আপনাদের যে পরিচিতি, এতটা ছড়ানো সম্ভব হত?

সুবিমল বসাক – একদিক দিয়ে প্রশ্নটা ঠিকই। হাংরি আন্দোলন আমরা কয়েকজন মিলে করেছিলাম। তখন যে সমস্ত লেখা হয়েছিল, সেটা তো প্রচলিত সাহিত্যধারার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। ভাষার ব্যবহার, বিষয় – সবক্ষেত্রেই। অথচ অনেকে বলে, ‘ওরা তো হাংরি লেখক!’ যেন লেখালিখি ছেড়ে অন্যান্য ব্যাপারের সঙ্গে যুক্ত! কিন্তু আমাদের লেখা আজও, পঞ্চাশ বছর হয়ে গেল, বলুক কেউ, ওই ধরণের লেখা আর কোথায় হচ্ছে? এখনও কেউ হাংরিদের লেখা নিয়ে এগিয়ে যাক না! বারণ তো করছে না কেউ! তখনকার সাহিত্যসমাজ আমাদের চেপে রাখার চেষ্টা করেছিল, যাতে আমাদের লেখা কারোর হাতে না পড়ে, কেউ জানতে না পারে যে এইধরণের আন্দোলন হয়েছে। কিন্তু পড়েছে। লুকিয়ে হলেও।

প্রশ্ন – নিষিদ্ধ শব্দের সমাহার ও নিষিদ্ধ উত্তেজনা পাওয়ার ট্রেন্ড থেকেই কি লুকিয়ে পড়ার প্রবণতা আসছে তাহলে?

সুবিমল বসাক – তাহলে তো সমস্ত সংস্কৃত সাহিত্যকেই ফেলে দিতে হয়! তা নয়। লোকের মনে একটা কনসেপ্ট তৈরি হয়ে গেছে যে, হাংরিদের লেখা মানেই কয়েকটা গালাগাল, কয়েকটা অশ্লীল শব্দ থাকবেই। ফলে পরিস্থিতিও এরকম দাঁড়িয়েছে। কিন্তু বাসুদেব দাশগুপ্ত, দেবী রায় এঁদের লেখায় তো অশ্লীল শব্দ প্রায় নেই বললেই চলে। ওঁরাও তো হাংরি বলেই পরিচিত!
হাংরি জেনারেশনে ক’জন ছিল আর? চার্জশিট হয়েছিল মোটে বারো জনের নামে। এই বারো জনই সমস্ত সাহিত্যটাকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল।

প্রশ্ন – সাহিত্যে যৌনতার প্রসঙ্গ এলেই কি তা নিষিদ্ধ হয়ে যায়?

সুবিমল বসাক – তা কেন হবে? একজন কবি কেন নিজের লেখা ‘নিষিদ্ধ’ মনে করতে যাবে? তাহলে তো সে লিখবেই না! তার কাছে সেটা নিষিদ্ধ নয় বলেই তো সে লিখেছে। বিনয় মজুমদারের ‘বাল্মীকির কবিতা’র কথায় ধরা যাক। ওগুলো যদি উনি নিষিদ্ধই মনে করতেন, তাহলে ছাপতে দেবেন কেন? রেখে দিতেন নিজের কাছে!
তখন, ’৬৫ সালে বিতর্ক উঠেছিল, এখন তো সাহিত্য অনেক এগিয়ে গেছে। মলয় তো যৌনতার ব্যবহার নিয়ে নানাভাবে লিখছে। ভাবাই যায় না, ওভাবেও লেখা সম্ভব! যৌনতা তো একটা সাবজেক্ট…

প্রশ্ন – কালোত্তীর্ণ সাহিত্য কি হাংরিদের হাত থেকে বেরিয়েছি্ল?

সুবিমল বসাক – কালোত্তীর্ণ কী? কে ওটা তৈরি করেছে, সেটাও তো বলতে হবে! আন্দোলনের সময় তো আমাদের চেপে রেখেছিল। উঠতে দেয়নি, গালাগাল দিয়েছিল। নিশ্চই ভয় পেত। নইলে তারা এরকম করবে কেন? বিনয় মজুমদারের বয়েই গেছে, তিনি সমস্ত খবরের কাগজ’কে লাথি মেরে চলে গেছেন। কিন্তু তিনিও তো লিখে গেছেন, সেগুলোও কালোত্তীর্ণ হবে, নিশ্চই হবে। শুধুমাত্র খবরের কাগজে কালোত্তীর্ণ হলেই সব হয় না। কত লেখা পড়ে আছে, অনেক বামপন্থী লেখক ছিলেন, যাঁদের কোনো সংকলনেই ঢোকানো হয়নি। সেটার বিচার করবে কে? সম্পাদক? এমন অনেক লেখক আছেন, যারা জীবদ্দশায় পাত্তা না পেলেও পরে লোকে খুঁজে খুঁজে পড়েছে তাঁদের লেখা।

প্রশ্ন – আপনি হাংরি আন্দোলনের অন্যতম গদ্যকার। আপনার লেখায় যৌনতা কীভাবে ধরা দিয়েছে?

সুবিমল বসাক – সেটা পাঠকই বলতে পারবে। লেখক হিসেবে আমার কাছে যৌনতার আলাদা কিছু তাৎপর্য নেই। যেমন ডাল-ভাত-জল খাচ্ছি, তেমনি যৌনতাও এসেছে। যেখানে যেখানে আসার, সেখানেই। তার জন্য আলাদা কোনো প্যারা খরচ করতে হয়নি আমায়। যৌনতা অনেকে ক্যাপিটাল হিসেবে ব্যবহার করে। আজকালকার সিনেমায় দেখা যায় সেটা।
‘বিবর’ লেখার জন্য সমরেশ বসু’কে প্রায় বয়কটই করা হয়েছিল। কিন্তু ‘বিবর’ না লিখে ওঁর কোনো উপায় ছিল না। কারন বাংলা সাহিত্য অনেক এগিয়ে গেছিল হাংরিদের দৌলতে। ওইসময় সেক্স নিয়ে যত হইচই হয়েছিল, এখন কিন্তু তা নয়! এতটাই স্বাভাবিক হয়ে গেছে সবকিছু।

প্রশ্ন – গত পঞ্চাশ বছরে বাঙালি জাতি এত সহনশীল হয়ে গেল কীভাবে, যাতে সবকিছুই স্বাভাবিক হিসেবে ধরা দিচ্ছে?

সুবিমল বসাক – প্রধান কারণ বিদেশী প্রভাব। এই যে মেয়েরা জিন্স পড়ছে, টপ পড়ছে, অনেকসময় খোলাই প্রায়; এই বিষয়টা এতই চোখ সয়ে গেছে যে এখন আর গোপন বলে কিছু নেই প্রায়। অনুসন্ধিৎসা নেই। মেয়েরা নানারকম কথাও বলছে, পাবলিক প্লেসে, যেগুলো আগে কখনো ভাবাও যেত না। কাজেই আগে মানুষের যে মুখোশ পরে থাকার ব্যাপারটা ছিল, সেটা ভেঙে গেছে।

প্রশ্ন – মলয় রায়চৌধুরীর ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটি অশ্লীলতার অভিযোগে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, কবিকে জেলেও যেতে হয়েছিল। আপনার চোখে কবিতাটি কীভাবে ধরা দিয়েছে?
সুবিমল বসাক – পুলিশ কেস দাখিল করেছিল অশ্লীল শব্দ, বিষয় ইত্যাদির অভিযোগ দেখিয়ে। শক্তি, সন্দীপন, শৈলেশ্বর, সুভাষ এরা বিরুদ্ধ সাক্ষ্য দিয়েছিল। আমার এখনও কবিতাটা নিষিদ্ধ মনে হয় না, তখনও হয়নি। সে সময়কার কবিতার জড়তা’কে একটা আঘাত দিয়েছিল মলয়। ও যে লিখেছে – “কেন আমি পিতার আত্মমৈথুনের পর তাঁর পেচ্ছাপে বয়ে যাইনি”, এই প্রশ্নটা তো অশ্লীল কবিতা লেখার উদ্দেশ্যে নয়; ওর নিজের প্রচণ্ড একটা জিজ্ঞাসাই ওকে দিয়ে লিখিয়েছে। তবু অশ্লীল! এটা সংস্কৃতে লিখলে কিন্তু দারুণ ব্যাপার হত। আর ইংরাজিতে লিখলে তো কথাই নেই…
প্রাচীন মন্দিরগুলোয় যেসব মিথুনমূর্তি আছে, সেগুলো’কে কী বলা হবে তাহলে? ভগবান সবই করতে পারে? খাজুরাহো মন্দিরে একটা ন্যুড মূর্তি আছে, সেটার বিশিষ্ট অঙ্গে হাত বুলোতে বুলোতে কালো করে দিয়েছে সবাই।

প্রশ্ন – আপনি কি আপনার লেখালিখি পরিবারের সঙ্গেও শেয়ার করে নিতে সমান সাবলীল?

সুবিমল বসাক – তাদের মন কীভাবে গড়ে উঠেছে সেটা তাদের ব্যাপার। আমার লেখা, আমার মন কীভাবে গড়ে উঠেছে সেটা আমার ব্যাপার। তাদের ইচ্ছে হলে পড়বে, না হলে পড়বে না। পরিণত বয়সে কারোর ওপর কিছু চাপিয়ে দেওয়া ঠিক নয়।
(‘আঙ্গিক’ পত্রিকায় প্রকাশিত)













বৃহস্পতিবার, ১০ ফেব্রুয়ারী, ২০১১

ধুর্জটি চন্দ লিখিত 'সুবিমল বসাকের উপন্যাস ছাতামাথা'

 (বাংলা সাহিত্যে পূর্ববঙ্গের ভাষায় রচিত [ ১৯৬৫ সালে ] প্রথম উপন্যাস ছাতামাথা  গ্রন্হের আলোচনা )


গত শতাব্দীতে বাংলা সাহিত্যে যে-উল্লেখযোগ্য আন্দোলনটির প্রভাবে সারা বাংলা তথা ভারতবর্ষ আলোড়িত হয়েছিল, যার ছায়া ক্রমশ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে আজও, সেই হাংরি জেনারেশন মুভমেন্ট-এর অন্যতম শরিক সুবিমল বসাক, একজন সুচারু ভাষাশিল্পী, একথা আজ অবশ্যমান্য।
'ছাতামাথা' নামে একটি অনন্যসাধারণ গ্রন্থের প্রণেতা তিনি। প্রকৃতপক্ষে এই গ্রন্হপাঠে আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছি। বস্তুত আলজিভ দিয়ে লেখা উপণভাসের স্বাদ গ্রহণে আমার জিভ অনভ্যস্ত। উল্লেখযোগ্য, গ্রন্হটি আগাগোড়া পূর্ববঙ্গের ভাষায় লেখা। মুখে-মুখে ডায়ালেক্ট ব্যবহার করা হয়ে থাকে সেই ভাষায়। এই গ্রন্হ আঞ্চলিক ভাষায় লেখা হয়ে থাকলেও আঞ্চলিক নয়। প্রমথ চৌধুরীর পর বাংলাদেশে গদ্য সাহিত্যে কমলকুমার মজুমদার এবং তারপর সুবিমল বসাক এক নতুন জোয়ার আনলেন। তাছাড়া এ-যাবৎ অনেক উপন্যাসই লেখা হয়েছে যা কিনা আঞ্চলিক উপন্যাস নামে অভিহিত। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'হাঁসুলিবাঁকের উপকথা', 'নাগিনীকন্যার কাহিনী'; সতীনাথ ভাদুড়ির 'ঢোঁড়াই চরিতমানস', অমিয়ভূষণ মজুমদারের 'গড় শ্রীখণ্ড' ইত্যাদি। কিন্তু আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করা সত্বেও এই গ্রন্হ যে ক্ষুদ্র অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, এক আধুনিক, অভূতপূর্ব সার্থক উপন্যাস হতে পেরেছে তা সুবিমলের পাওয়ার অফ অবজারভেশন ও বুদ্ধিকে মগজ থেকে গোড়ালিতে আনার এক মহৎ ফলশ্রুতি।
আরো আশ্চর্যভাবে লক্ষ করা যায় --- এখানে সংলাপ চলিত ভাষায় ব্যবহার করছেন এবং ভাষা-ভূমি পূর্ববঙ্গের। মৃনাল সেনের ভূবন সোম হিন্দিতে কথা বলেছেন বটে, কিন্তু যখনি তিনি চিন্তা করেছেন ভিতরে-ভিতরে, আমরা ভুলি না ভূবন সোম বাঙালি চরিত্র। আমার শরীরে ঢাকার নীল রক্ত থাকা সত্বেও সুবিমল বসাকের এই গ্রন্হপাঙে আমাকে বেশ পরিশ্রম করতে হয়েছে। যারা এই দেশীয়, পূর্ববঙ্গীয় নন, তাঁদের পক্ষে এগ্রন্হ উদ্ধার করা শ্রমসাপেক্ষ। এ-গ্রন্হ চলিত ভাষায় লেখা হলে আরও বেশি পাঠক রসগ্রহণে সক্ষম হতেন এবং আধুনিকতা সম্পর্কে সচেতন হতেন বলে আমার বিশ্বাস। সর্বোপরি, বলা যায়, এই গ্রন্হপাঠে এক অদ্ভুত জগতের আবিষ্কার হয়।
আটটি অংশে বিভক্ত এই গ্রনহটিকে উপন্যাস নামে অভিহিত করা হয়েছে। উপন্যাস বলে এতদিন আমরা যা বুঝে এসেছি, এ গ্রন্হ তা নয়। এর প্রত্যেকটি অংশই খাপছাড়া। ১নং গদ্যের সঙ্গে ২নং গদ্যের কোনো মিল নেই, ২নং গদ্যের সঙ্গে ৩নং, ৩নং এর সঙ্গে ৪নং গদ্যের কোনো মিল নেই, এই খাপছানো ভাব এই গ্রন্হে আগাগোড়া। অথচ একটি যোগসূত্র এই গ্রন্হের নায়ক 'আমি'। এই 'আমি'কে কেন্দ্র করেই সুবিমল দেখিয়ে দিয়েছেন কিভাবে চিতায় শুয়ে মুখাগ্নিরত শোকাতুর হাতকে কামড়ে ধরতে হয়।
্র নায়ককে দেখি গোঁয়ার, গবেট, একমুখী, অভিমানী, সেন্টিমেন্টাল -- যে বিহ্বল, বিমূঢ় হয়ে গেছে সমাজের ব্যবহারে, মানুষের ব্যবহারে, বন্ধুবান্ধবীর ব্যবহারে। কখনও সে ক্রোধে ফেটে পড়ছেকখনও নিজের ভুলের জন্য হাত কামড়াচ্ছে, হাঁটু মুড়ে ক্ষমা চাইছে, কখনও বা ক্ষুব্ধ হচ্ছে। যা চাইছে তা ঘটছ না, যা ঘটছে তা কখনওম করেনি, বিচার হওয়ার পূর্বেই সে অপরাধী বলে প্রমাণিত, অথচ কিসের অপরাধ তা সে জানে না। এই ধরনের নেপথ্য কাহিনী আজও দেখতে পাই। সুবিমলের এই গ্রন্হ পড়তে-পড়তে মাঝে-মাঝে আমার মনে হয়েছিল যে এই পৃথিবীটা ট্যান্টালাসের নরক।( গ্রিক পুরাণে ট্যান্টালাস নামে এক রাজার কাহিনী লিপিবদ্ধ আছে। দেবতার অভিশাপে তিনি পাতালে নিক্ষিপ্ত হলেন। সেই পাতালে থেকে তিনি ক্ষুধার্ত এবং তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়েন। অমনি তার চোখের সামনে নানাবিধ ফলমূল ঝুলিয়ে ধরা হল। তিনিও অমনি হাত বাড়ালেন। কিন্তু আশ্চর্য! সঙ্গে-সঙ্গে ফলমূল উধাও হল।ঝরণার বারি দেখে তিনি হাঁ করলেন। কিন্তু সঙ্গে-সঙ্গে তাও অদৃশ্য হল।এই ভাবে ট্যান্টালাস ক্ষুধা-তৃষ্ণায় তিলে-তিলে মারা গেলেন। গ্রিক পুরাণে এটাকেই ট্যান্টালাসের নরক বলা হয় ) বাস্তবিকই তা। যাদের শরীরে এখনও আলপিন গেঁথে গেলে যন্ত্রণা হয় ----- অর্থাৎ চামড়া এখনো মোটা হয়নি ----- তারা প্রত্যেকে প্রতি মুহূর্তে এর সত্যতা উপলব্ধি করেন। কাজেই এটা স্বাভাবিক, সুবিমল ভিক্টিম।জন্মের পরমুহূর্ত থেকে একটি শিশু যেমন ট্র্যাপের ভিতর সেঁধিয়ে পড়াছে ----- এবং সে জানে না তাকে কে কোনদিক থেকে ঠেসে ধরতে চায়। যেমন 'তুলো জানে না তাকে কোন রঙে ছুপিয়ে কার দলের পতাকা করা হবে'।
'ছাতামাথা-র কোনো-কোনো অংশ জার্কিঙের কাজ করে। মগজকে চমকিত করে তোলে। পড়তে-পড়তে হাত বুকের ওপর চলে আসে। দীর্ঘশ্বাস বের হয়। Contemplation is engulfed by action, যারা এ-ধারণা পোষণ করেন, সুবিমলের এই গ্রন্হ তাদের মগজ ধোলাই করতে সাহায্য করবে। Contemplation এবং Actionকে সুবিমল সব্যসাচীর মত কাজে লাগিয়েছেন। ৪নং অংশে যে-ভয়ংকর মুহূর্তের বিশেষ অবতারণা করেছেন --- জীবনে যে-সব ভয়াল পরিণতি অধবা পরিণতির সেই সব ভয়াল মুহূর্ত --- অর্থাৎ মুহূর্ত-বিশেষের পরিবেশ, সেই সব ঘটনা জীবন থেকে বিতাড়ন অসম্ভব।শরীরের চামড়া থেকে গর্ভের গন্ধ সরানো সম্ভব নয়, এবং এরই ধাক্কায় ফেটে পড়ে নানান বোধ --- নিঃসন্দেহে এক নতুন ও ভয়ংকর লেখা । কিংবা ৭নং অংশের লেখা। এধরণের লেখার সঙ্গে পূর্বে কেউ পরিচিত ছিলেন কি না আমার জানা নেই। সুররিয়্যালিজম ন্দোলনে 'অটোমেটিক রাইটিং' -এর প্রচলন ঘটেছিল । এই অংশ সেই বিশেষ লেখন-প্রক্রিয়াকে মনে করিয়ে দেয়। মানুষের টোটালিটি অর্থাৎ একজন মানুষের ভিতর যা থাকে --- ব্যক্তিগত লোভ, হিংসা, মোহ, প্রজানীতি, আতঙ্ক, কপটতা, ভালবাসা, উন্মাদনা, ট্রিকস, ধর্মবোধ, ল্যাং মারামারি, উদারতে, মিননেস, সাধুতা, ছ্যাঁচড়ামি, ঈর্ষা, সাফোকেশান ( গেরিলা আক্রোশ ) সবই হাজির হয়। তাই সুবিমলকে কখনো নিষ্ঠুর, কখনো বিবেক যন্ত্রণায় আক্রান্ত, কখনো অপরিচিত দেখি। হোটেলে একটি মেয়ের মাথা কাপড়ে পাক দিয়ে ঠেসে আগলা নগ্ন শরীরের প্রতি তার মন্ত্রোচ্চারণ চলে --- সবিতা, চন্দ্রাবতী, শকুন্তলা, নীহার, অণিমা, শর্মিলা ও অরুন্ধতী.... ধরা পড়ে যায় চালাকি। নারীর মগজ বাদ দিয়ে শারীরিক প্রয়োজনীয়তা একই --- একথা বোঝার পরে কিছুই থাকে না। কিংবা নায়কের ৫৬৭৮৯-এ রূপান্তরিত হওয়া । 'ক' বাবু জীবনের সঙ্গে আপোস করতে গিয়ে একের পর এক জিনিসের ব্যবহার --- দুরবিন, ডাইরি, গ্রামোফোন --- এই সব উঠে আসে মানুষের কাছে ঘুষের মত। এবং এসবের যখন প্রয়োজন থাকে না, অর্থাৎ জীবনে বেঁচে থাকার মত কোনো কারণ থাকে না --- শিশিরের শব্দের মত সন্ধ্যা নেমে আসে। সুবিমল যখন লেখেন, "গতর থিক্যা হগল সংস্কারের ধুলা ঝাইড়্যা ফেলছি--- তবুও পিরান থিক্যা বাইরাইতে পারি না --- নারীর কাছে সর্বস্ব সমর্পণ করেও প্রতারিত, বিভ্রান্ত, সংস্কার কাটিয়েও বেরোতে পারছেন না, তখন খুব স্বাভাবিক ভাবেই আমার স্টেফানোৎসভাইকের  Twenty four hours in the life of a woman মনে পড়ে। সুনু ওরফে কৃষ্ণা একজন নারী। এই নারীকে কেন্দ্র করে সুবিমল তাঁর চারপাশ খুঁটিয়ে দেখেছেন। নারী নিয়ে সাহিত্যে এমনকিছু লিখলে ন্যাকামি হয়, কিন্তু জীবনে নারীর প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না।পিকাসোর ব্লু পিরিয়ডের মত এটাও তাঁর রেড পিরিয়ড। হাহাকার, নিজের অপদার্থতা, ভুল জায়গায় নির্ভুল ভালবাসা, ভুল রমণীকে হৃদয় দান --- এই সব রেড পিরিয়ডে দেখা যায়। তাছাড়া লেখায় ভয়ংকর ব্যাপার থাকা সত্বেও এক কবিত্ব লক্ষ্য করা যায়। সম্ভবত আঞ্চলিক ভাষায় বলেই কবিত্ব ফুটে ওঠে কোথাও-কোথাও।
সুবিমলের এই stream of consciousnessকে ভয়ংকর সুন্দর বলে মনে হয়। আঞ্চলিক ভাষায় এটা যেন স্বতঃস্ফূর্ত------- "আমি যেই রাস্তা দিয়া চিলি ফিরি, অন্যেরা হেই রাস্তা দিয়া চলাফিরা করে না। আমার রাস্তাঘাত এক্কেরে আপনরাস্তা । আমি যা দেহি, অন্যেরা হেই লেহান দ্যাহে না। মাঠ-ময়দানের ঘাস আমার চোহে লালবর্ণ ----- অন্যেরা দ্যাহে হইলদা। আমি যারে দেহি রক্ত, অন্যেরা দ্যাহে পানি, আমি যারে কই হেজ, অন্যেরা কয় কব্বর।"
এরপর আর মোরাভিয়ার  Dialect is an inferior form of expression because it is less cultivated form--- এই উক্তি খাটে না। অবশ্য মোরাভিয়া যদি বাঙালি হতেন, তাহলে নিজেই তাঁর ধারণা পালটে ফেলতেন বলে আমার বিশ্বাস।
( ছিটেফোঁটা পত্রিকার বইমেলা ২০০০ সুবিমল বসাক সম্বর্ধনা সংখ্যা থেকে পুনঃপ্রকাশিত )

বুধবার, ৯ ফেব্রুয়ারী, ২০১১

অজয় সেন লিখিত 'হাবিজাবি, বকবকানি ও খোলা জানলা'

সুবিমল বসাকের সাথে প্রথম আলাপ কলেজ স্ট্রীটের 'বিভূতি কেবিনে'। সেখানে শৈলেশ্বর, বাসুদেব, সুভাষ অনেকেই আসত, কাছাকাছি কফিহাউস থাকা সত্তেও 'বিভূতি কেবিন' তাদের অনায়াসে সাঁতরানোর জায়গা ছিল।১৯৬৩-৬৪-এর ওই  আড্ডাখানায় শুনতাম বেশি, লক্ষ্য করতাম বেশি হাংরির নব্যযুবকদের, এদের মধ্যে আমার কাছে আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ছিল বাসুদেব দাশগুপ্ত ও সুবিমল বসাক। পরে সুবিমলের সঙ্গে অন্তরঙ্গতার কারণে এক ধরণের ভালোলাগা জন্ম নিয়েছিল, বলা বাহুল্য, আজও যা চিড় খায়নি এতটুকু। ওর অফিসে গিয়ে অনেক দিন অনেক সময় কাটিয়েছি, ডিপার্টমেন্টের প্রত্যেকটি কর্মচারীর নাম. কে কি রকম, কার কি দুর্বলতা, কি কি গুণ খুঁটিনাটি আমাকে সে বলত নিচুস্বরে, চা খেতে-খেতে এই সব গল্প হত আমাদের। আর যে আলোচনার মধ্যে এসব কিছুই থাকত না, তা হল লেখালিখি। সে নিজেরই হোক বা অপরেরই হোক। বিশেষ করে অপেক্ষাকৃত তরুণদের লেখালিখি সুবিমল বেশ মনোযোগ দিয়েই পড়ত, যেটা আমার তাকে ভালো লাগার কারণ। কে কোথায় একটা ভালো লেখা লিখেছেন, সেই লেখার সমালোচনা করে ভালো কি মন্দ অনায়াসে জানিয়ে দিত। আমার লেখা যে সে পছন্দ করে তা প্রথম দিন আলাপের পরই জানিয়েছিল, অবাক হয়েছিলাম বেশ খানিকটা। মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন হয়েছিলাম এই কারণে সদ্য লিখতে আসা নব্য যুবককে উৎসাহ ও প্রচ্ছন্ন সাহস যোগানোর জন্য।
সুবিমল বসাক প্রকৃত অর্থে ছাই-চাপা আগুন। সে সময় হাংরি আন্দোলন ঝড় তুলেছিল দেশে তো বটেই, বিদেশেও তার ঝাপটা লেগেছিল, সে সময় পুতু পুতু রক্ষণশীলরা চেঁচামেচি শুরু করেন, ফলতঃ শ্লীল-অশ্লীল সাহিত্য রচনা করেছেন, সমাজের ভেজানো দরোজা একের পর এক খুলে দিচ্ছেন, তাদের এসব উদ্যম চিন্তাভাবনা ভালো লাগেনি প্রশাসন এবং এক শ্রেণীর ব্যাঙদের কাছে, ফলতঃ ধরপাকড়, হাজতবাস, কোর্টকাছারি অমোঘ হয়ে নেমে আসে হাংরি আন্দোলনের কবি-সাহিত্যিকদের ওপর। এদের মধ্যে অনেকে,( যেমন শৈলেশ্বর ঘোষ, সুভাষ ঘোষ ) মুচলেকা দিয়ে দেন, ভাবটা এমনই যে ওপাড়ায় আমি নেজে যাইনি, আমাকে ওরা নিয়ে গেছিলো। সুবিমল ও অন্য কয়েকজন নিজেদের মতই লেখালিখি করে গেছেন। কাউকে, কোনো কিছুকে তোয়াক্কা না করেই। সুবিমলের লেখার মধ্যে একটা প্রাদেশিক সাযুজ্য লক্ষ করি। গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ যেমন লিখেছেন, পাশাপাশি প্রাদেশিক কবিতা অনুবাদ এবং জীবনীগ্রন্হ রচনাতেও মাহিরিআনা দেখিয়েছেন। দুটো উপন্যাস, ছয়টি গল্প-গদ্য সংগ্রহ, দুটি কবিতার নিজস্ব চটি বই।প্রবন্ধ অনুবাদ করেছেন অনেক। অনুবাদ সাহিত্যে ২০০৭ সালে যশপাল রচিত অকাদেমি পুরস্কারে ভূষিত সুবিমল। যদিও তা অনেক আগেই পাওয়া উচিত ছিল।
সুবিমল বসাকের লেখালিখি --- প্রথম কবিতার বই 'হাবিজাবি' যখন প্রকাশিত, তখন হাংরি আন্দোলন তুঙ্গে। অধিকাংশ কবিতা ওই সময়ের লেখা, মনে হয় নিজের সম্পর্কে ভাবনা, সমাজের উঠোনে নিজেকে নগ্ন করে খতিয়ে দেখা, নিজের পরিবেশকে খুঁড়তে-খুঁড়তে নিজের সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিকোণ, ভাবনা আবিষ্কার করা। ফলতঃ কবিতাগুলোয় প্রেম-অপ্রেম, ভালোবাসা-ভালোবাসাহীনতা, চোরাস্রোতের মত চিন্তা, ঈর্ষা, স্নেহ, জীবন-পারাপার-ভাবনা, দুঃখকষ্ট, অবজ্ঞা-উপহাস, হতাশা, চিল-চিৎকার যাবতীয় ব্যাপার উঠে এসেছে ওই কবিতাগুলির মধ্যে।
আমি কবিতা পড়তে ভালোবাসি। কবিতার প্রতি আমার যথেষ্ট দুর্বলতা আছে, তো যেটা লক্ষ করি, 'হাবিজাবি' কবিতার বইয়ের মধ্যে, তা হলো ভাষা। সুবিমলের কথায় --- আমার মায়ের ভাষা। পূর্ববাংলার ভাষা তো মাটির ভাষা। এখন লক্ষনীয় 'মা' কোন অর্থে? দেশ-মা না গর্ভধারিণি-মা ? এক অদ্ভুত দেশজ কধ্য ভাষায় এরকম লেখা আমি কখনও পড়িনি। বাংলা সাহিত্যে কবিতার জগতে সুবিমল পাথ-ব্রেকিং।
১৯৭০ থেকে ২০০০ সালে প্রায় তিরিশ বছর বাদে দ্বিতীয় কবিতার বই 'বকবকানি' । মোট চব্বিশটি কবিতার চটি বই। রাজনীতি, ব্যাঙ্গ, যৌনতা, দার্শনিক স্ট্রিট রিয়্যালিটির পাশ কাটিয়ে এক মানভাষার আকুতি। 'বকবকানি' সে-অর্থে এক সার্থক দলিল। অবশ্য হাংরি আন্দোলনের বাঁকবদল ছিল উত্তরঔপনিবেশিক এপার-বাংলার ফসল। সমাজ তার নিজস্ব প্রক্রিয়ায় যে জীবনবোধ গড়ে দেয়, তা থেকে এই মোড়বদল আলাদা করা যায়। কবিতা ছাড়াও সুবিমল বসাক অত্যন্ত নিপুণভাবে গদ্য রচনা করেছেন; গদ্য সংগ্রহ যে কয়টি হাতে পেয়েছি, ইতস্তত পত্র-পত্রিকায় পড়েছি, মনে হয়েছে সুবিমল আরও গদ্য লিখতে পারতেন। তবে তিনি যে একজন সফল গদ্যকার এ-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তিনি হিন্দি কবিতার সঙ্গে পাঠকদের পরিচয় করিয়ে দেন 'প্রতিবেশি জানালায়'। অনুবাদ সাহিত্যেও সুবিমল যে মাহির তা বলাই বাহুল্য।
অনুবাদ সাহিত্যে গল্পের মধ্যে ফণীশ্বরনাথ রেণুর 'তিসরি কসম', শ্রেষ্ঠ গল্প প্রেমচন্দের 'পঞ্চ পরমেশ্বর', 'দুই সখী'। প্রবন্ধ অনুবাদের ক্ষেত্রে 'জীবনসার', হিন্দি কবিতার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সংকলন 'প্রতিবেশিন জানালা'। শ্রীকান্ত বর্মার 'উজ্জয়িনীর রাস্তা', জগদীশ চতুর্বেদীর 'বোবাদের পল্লীতে' যথেষ্ট দাগ কাটে পাঠকদের মনে, কারণ প্রত্যেকটি অনুবাদ-কবিতায় হাংরি কবিতার ঝলক উঁকি মারে। কবিতার জীবনকে সামলাতে না পারলে পড়ে যাবার সম্ভাবনা থেকেই যায় --- পাঠককুলকে তাই খবরদারি, সাবধানবাণী প্রকৃতই চেতাবনি। সুবিমল বসাক ঢাকায় গেছিলেন তাঁদের পৈত্রিক বাড়ির আশে-পাশে যে-সব বুজুর্গরা থাকতেন, তাঁদেরই সান্ধ্য আসরে তাঁদের অনুরোধে লুপ্তপ্রায় এক প্রাচীন শিল্পকলাকে তুলে ধরেছেন। ঢাকার হিন্দু বাঙালিদের 'বিয়ার গীত' ও 'ঢাকাই ছড়া' সংকলনে। খাস কলকাতায় বছর তিরিশ পূর্বেও বিবাহ উৎসবে এসব গানের প্রচলন ছিল, ক্রমশ হ্রাস পেতে-পেতে এসব গান আজ আর কোনো বিবাহ অনুষ্ঠানে শোনা যায় না, হয়তো আর্থ সামাজিক, শহুরে মানসিকতার সঙ্গে খাপ খায়নি, দ্বিতীয়ত এসব গানের উত্তরসূরী তাঁরা রেখে যাননি, তবু এখনও গ্রামাঞ্চলে কোনো প্রাচীনা, বিবাহ উৎসবে আনন্দে উত্তেজনায় গুনগুন করে গেয়ে উঠছেন এই সব গান।তা সুবিমল বসাকের অবদান।
হাংরি আন্দোলনের পুরোধা সুবিমল বসাক প্রকৃত অর্থে বহু বিচিত্র শিল্পগামী। এখনও তাঁকে লিখে যেতে ব্যক্তিগতভাবে অনুরোধ করি। তার কারণ তিনি জানেন এমন গদ্য অথবা কবিতা নেই--- যা পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম ঠাণ্ডাযুদ্ধও থামিয়ে দিতে পারে --- তাই সুবিমলকে অনুরোধ--- লিখুন, আরও লিখুন। থামিয়ে দিন পৃথিবীর ঙাণ্ডাযুদ্ধ ও উলঙ্গ বিবাদ।

ছিটেফোঁটা পত্রিকার বইমেলা ২০০০ সুবিমল বসাক সম্বর্ধনা সংখ্যা থেকে পুনঃপ্রকাশিত