বৃহস্পতিবার, ১০ ফেব্রুয়ারী, ২০১১

ধুর্জটি চন্দ লিখিত 'সুবিমল বসাকের উপন্যাস ছাতামাথা'

 (বাংলা সাহিত্যে পূর্ববঙ্গের ভাষায় রচিত [ ১৯৬৫ সালে ] প্রথম উপন্যাস ছাতামাথা  গ্রন্হের আলোচনা )


গত শতাব্দীতে বাংলা সাহিত্যে যে-উল্লেখযোগ্য আন্দোলনটির প্রভাবে সারা বাংলা তথা ভারতবর্ষ আলোড়িত হয়েছিল, যার ছায়া ক্রমশ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে আজও, সেই হাংরি জেনারেশন মুভমেন্ট-এর অন্যতম শরিক সুবিমল বসাক, একজন সুচারু ভাষাশিল্পী, একথা আজ অবশ্যমান্য।
'ছাতামাথা' নামে একটি অনন্যসাধারণ গ্রন্থের প্রণেতা তিনি। প্রকৃতপক্ষে এই গ্রন্হপাঠে আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছি। বস্তুত আলজিভ দিয়ে লেখা উপণভাসের স্বাদ গ্রহণে আমার জিভ অনভ্যস্ত। উল্লেখযোগ্য, গ্রন্হটি আগাগোড়া পূর্ববঙ্গের ভাষায় লেখা। মুখে-মুখে ডায়ালেক্ট ব্যবহার করা হয়ে থাকে সেই ভাষায়। এই গ্রন্হ আঞ্চলিক ভাষায় লেখা হয়ে থাকলেও আঞ্চলিক নয়। প্রমথ চৌধুরীর পর বাংলাদেশে গদ্য সাহিত্যে কমলকুমার মজুমদার এবং তারপর সুবিমল বসাক এক নতুন জোয়ার আনলেন। তাছাড়া এ-যাবৎ অনেক উপন্যাসই লেখা হয়েছে যা কিনা আঞ্চলিক উপন্যাস নামে অভিহিত। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'হাঁসুলিবাঁকের উপকথা', 'নাগিনীকন্যার কাহিনী'; সতীনাথ ভাদুড়ির 'ঢোঁড়াই চরিতমানস', অমিয়ভূষণ মজুমদারের 'গড় শ্রীখণ্ড' ইত্যাদি। কিন্তু আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করা সত্বেও এই গ্রন্হ যে ক্ষুদ্র অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, এক আধুনিক, অভূতপূর্ব সার্থক উপন্যাস হতে পেরেছে তা সুবিমলের পাওয়ার অফ অবজারভেশন ও বুদ্ধিকে মগজ থেকে গোড়ালিতে আনার এক মহৎ ফলশ্রুতি।
আরো আশ্চর্যভাবে লক্ষ করা যায় --- এখানে সংলাপ চলিত ভাষায় ব্যবহার করছেন এবং ভাষা-ভূমি পূর্ববঙ্গের। মৃনাল সেনের ভূবন সোম হিন্দিতে কথা বলেছেন বটে, কিন্তু যখনি তিনি চিন্তা করেছেন ভিতরে-ভিতরে, আমরা ভুলি না ভূবন সোম বাঙালি চরিত্র। আমার শরীরে ঢাকার নীল রক্ত থাকা সত্বেও সুবিমল বসাকের এই গ্রন্হপাঙে আমাকে বেশ পরিশ্রম করতে হয়েছে। যারা এই দেশীয়, পূর্ববঙ্গীয় নন, তাঁদের পক্ষে এগ্রন্হ উদ্ধার করা শ্রমসাপেক্ষ। এ-গ্রন্হ চলিত ভাষায় লেখা হলে আরও বেশি পাঠক রসগ্রহণে সক্ষম হতেন এবং আধুনিকতা সম্পর্কে সচেতন হতেন বলে আমার বিশ্বাস। সর্বোপরি, বলা যায়, এই গ্রন্হপাঠে এক অদ্ভুত জগতের আবিষ্কার হয়।
আটটি অংশে বিভক্ত এই গ্রনহটিকে উপন্যাস নামে অভিহিত করা হয়েছে। উপন্যাস বলে এতদিন আমরা যা বুঝে এসেছি, এ গ্রন্হ তা নয়। এর প্রত্যেকটি অংশই খাপছাড়া। ১নং গদ্যের সঙ্গে ২নং গদ্যের কোনো মিল নেই, ২নং গদ্যের সঙ্গে ৩নং, ৩নং এর সঙ্গে ৪নং গদ্যের কোনো মিল নেই, এই খাপছানো ভাব এই গ্রন্হে আগাগোড়া। অথচ একটি যোগসূত্র এই গ্রন্হের নায়ক 'আমি'। এই 'আমি'কে কেন্দ্র করেই সুবিমল দেখিয়ে দিয়েছেন কিভাবে চিতায় শুয়ে মুখাগ্নিরত শোকাতুর হাতকে কামড়ে ধরতে হয়।
্র নায়ককে দেখি গোঁয়ার, গবেট, একমুখী, অভিমানী, সেন্টিমেন্টাল -- যে বিহ্বল, বিমূঢ় হয়ে গেছে সমাজের ব্যবহারে, মানুষের ব্যবহারে, বন্ধুবান্ধবীর ব্যবহারে। কখনও সে ক্রোধে ফেটে পড়ছেকখনও নিজের ভুলের জন্য হাত কামড়াচ্ছে, হাঁটু মুড়ে ক্ষমা চাইছে, কখনও বা ক্ষুব্ধ হচ্ছে। যা চাইছে তা ঘটছ না, যা ঘটছে তা কখনওম করেনি, বিচার হওয়ার পূর্বেই সে অপরাধী বলে প্রমাণিত, অথচ কিসের অপরাধ তা সে জানে না। এই ধরনের নেপথ্য কাহিনী আজও দেখতে পাই। সুবিমলের এই গ্রন্হ পড়তে-পড়তে মাঝে-মাঝে আমার মনে হয়েছিল যে এই পৃথিবীটা ট্যান্টালাসের নরক।( গ্রিক পুরাণে ট্যান্টালাস নামে এক রাজার কাহিনী লিপিবদ্ধ আছে। দেবতার অভিশাপে তিনি পাতালে নিক্ষিপ্ত হলেন। সেই পাতালে থেকে তিনি ক্ষুধার্ত এবং তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়েন। অমনি তার চোখের সামনে নানাবিধ ফলমূল ঝুলিয়ে ধরা হল। তিনিও অমনি হাত বাড়ালেন। কিন্তু আশ্চর্য! সঙ্গে-সঙ্গে ফলমূল উধাও হল।ঝরণার বারি দেখে তিনি হাঁ করলেন। কিন্তু সঙ্গে-সঙ্গে তাও অদৃশ্য হল।এই ভাবে ট্যান্টালাস ক্ষুধা-তৃষ্ণায় তিলে-তিলে মারা গেলেন। গ্রিক পুরাণে এটাকেই ট্যান্টালাসের নরক বলা হয় ) বাস্তবিকই তা। যাদের শরীরে এখনও আলপিন গেঁথে গেলে যন্ত্রণা হয় ----- অর্থাৎ চামড়া এখনো মোটা হয়নি ----- তারা প্রত্যেকে প্রতি মুহূর্তে এর সত্যতা উপলব্ধি করেন। কাজেই এটা স্বাভাবিক, সুবিমল ভিক্টিম।জন্মের পরমুহূর্ত থেকে একটি শিশু যেমন ট্র্যাপের ভিতর সেঁধিয়ে পড়াছে ----- এবং সে জানে না তাকে কে কোনদিক থেকে ঠেসে ধরতে চায়। যেমন 'তুলো জানে না তাকে কোন রঙে ছুপিয়ে কার দলের পতাকা করা হবে'।
'ছাতামাথা-র কোনো-কোনো অংশ জার্কিঙের কাজ করে। মগজকে চমকিত করে তোলে। পড়তে-পড়তে হাত বুকের ওপর চলে আসে। দীর্ঘশ্বাস বের হয়। Contemplation is engulfed by action, যারা এ-ধারণা পোষণ করেন, সুবিমলের এই গ্রন্হ তাদের মগজ ধোলাই করতে সাহায্য করবে। Contemplation এবং Actionকে সুবিমল সব্যসাচীর মত কাজে লাগিয়েছেন। ৪নং অংশে যে-ভয়ংকর মুহূর্তের বিশেষ অবতারণা করেছেন --- জীবনে যে-সব ভয়াল পরিণতি অধবা পরিণতির সেই সব ভয়াল মুহূর্ত --- অর্থাৎ মুহূর্ত-বিশেষের পরিবেশ, সেই সব ঘটনা জীবন থেকে বিতাড়ন অসম্ভব।শরীরের চামড়া থেকে গর্ভের গন্ধ সরানো সম্ভব নয়, এবং এরই ধাক্কায় ফেটে পড়ে নানান বোধ --- নিঃসন্দেহে এক নতুন ও ভয়ংকর লেখা । কিংবা ৭নং অংশের লেখা। এধরণের লেখার সঙ্গে পূর্বে কেউ পরিচিত ছিলেন কি না আমার জানা নেই। সুররিয়্যালিজম ন্দোলনে 'অটোমেটিক রাইটিং' -এর প্রচলন ঘটেছিল । এই অংশ সেই বিশেষ লেখন-প্রক্রিয়াকে মনে করিয়ে দেয়। মানুষের টোটালিটি অর্থাৎ একজন মানুষের ভিতর যা থাকে --- ব্যক্তিগত লোভ, হিংসা, মোহ, প্রজানীতি, আতঙ্ক, কপটতা, ভালবাসা, উন্মাদনা, ট্রিকস, ধর্মবোধ, ল্যাং মারামারি, উদারতে, মিননেস, সাধুতা, ছ্যাঁচড়ামি, ঈর্ষা, সাফোকেশান ( গেরিলা আক্রোশ ) সবই হাজির হয়। তাই সুবিমলকে কখনো নিষ্ঠুর, কখনো বিবেক যন্ত্রণায় আক্রান্ত, কখনো অপরিচিত দেখি। হোটেলে একটি মেয়ের মাথা কাপড়ে পাক দিয়ে ঠেসে আগলা নগ্ন শরীরের প্রতি তার মন্ত্রোচ্চারণ চলে --- সবিতা, চন্দ্রাবতী, শকুন্তলা, নীহার, অণিমা, শর্মিলা ও অরুন্ধতী.... ধরা পড়ে যায় চালাকি। নারীর মগজ বাদ দিয়ে শারীরিক প্রয়োজনীয়তা একই --- একথা বোঝার পরে কিছুই থাকে না। কিংবা নায়কের ৫৬৭৮৯-এ রূপান্তরিত হওয়া । 'ক' বাবু জীবনের সঙ্গে আপোস করতে গিয়ে একের পর এক জিনিসের ব্যবহার --- দুরবিন, ডাইরি, গ্রামোফোন --- এই সব উঠে আসে মানুষের কাছে ঘুষের মত। এবং এসবের যখন প্রয়োজন থাকে না, অর্থাৎ জীবনে বেঁচে থাকার মত কোনো কারণ থাকে না --- শিশিরের শব্দের মত সন্ধ্যা নেমে আসে। সুবিমল যখন লেখেন, "গতর থিক্যা হগল সংস্কারের ধুলা ঝাইড়্যা ফেলছি--- তবুও পিরান থিক্যা বাইরাইতে পারি না --- নারীর কাছে সর্বস্ব সমর্পণ করেও প্রতারিত, বিভ্রান্ত, সংস্কার কাটিয়েও বেরোতে পারছেন না, তখন খুব স্বাভাবিক ভাবেই আমার স্টেফানোৎসভাইকের  Twenty four hours in the life of a woman মনে পড়ে। সুনু ওরফে কৃষ্ণা একজন নারী। এই নারীকে কেন্দ্র করে সুবিমল তাঁর চারপাশ খুঁটিয়ে দেখেছেন। নারী নিয়ে সাহিত্যে এমনকিছু লিখলে ন্যাকামি হয়, কিন্তু জীবনে নারীর প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না।পিকাসোর ব্লু পিরিয়ডের মত এটাও তাঁর রেড পিরিয়ড। হাহাকার, নিজের অপদার্থতা, ভুল জায়গায় নির্ভুল ভালবাসা, ভুল রমণীকে হৃদয় দান --- এই সব রেড পিরিয়ডে দেখা যায়। তাছাড়া লেখায় ভয়ংকর ব্যাপার থাকা সত্বেও এক কবিত্ব লক্ষ্য করা যায়। সম্ভবত আঞ্চলিক ভাষায় বলেই কবিত্ব ফুটে ওঠে কোথাও-কোথাও।
সুবিমলের এই stream of consciousnessকে ভয়ংকর সুন্দর বলে মনে হয়। আঞ্চলিক ভাষায় এটা যেন স্বতঃস্ফূর্ত------- "আমি যেই রাস্তা দিয়া চিলি ফিরি, অন্যেরা হেই রাস্তা দিয়া চলাফিরা করে না। আমার রাস্তাঘাত এক্কেরে আপনরাস্তা । আমি যা দেহি, অন্যেরা হেই লেহান দ্যাহে না। মাঠ-ময়দানের ঘাস আমার চোহে লালবর্ণ ----- অন্যেরা দ্যাহে হইলদা। আমি যারে দেহি রক্ত, অন্যেরা দ্যাহে পানি, আমি যারে কই হেজ, অন্যেরা কয় কব্বর।"
এরপর আর মোরাভিয়ার  Dialect is an inferior form of expression because it is less cultivated form--- এই উক্তি খাটে না। অবশ্য মোরাভিয়া যদি বাঙালি হতেন, তাহলে নিজেই তাঁর ধারণা পালটে ফেলতেন বলে আমার বিশ্বাস।
( ছিটেফোঁটা পত্রিকার বইমেলা ২০০০ সুবিমল বসাক সম্বর্ধনা সংখ্যা থেকে পুনঃপ্রকাশিত )

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন