মঙ্গলবার, ৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১১

সুবিমল বসাকের হাবিজাবি--- ২১শে ফেব্রুয়ারি ও পাপের চেহারা

ফালগুনী রায় লিখিত

২১শে ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষা আন্দোলনে শহিদেরা সুবিমল বসাকের মতই প্যান্ট-শার্ট বা পাজামা-পাঞ্জাবি পরে ছিলেন, বাংলা ভাষার জন্যে নিহত না হলেও সুবিমল শহিদ হয়েছিলেন বাঙাল ভাষার জন্যে -- অর্থাৎ মসী, অসি অপেক্ষাও শক্তিশালী এই প্রবচনের সূত্র ধরে বলা যায় কলকাতার অ্যাকাডেমিক অধ্যাপক বা আধুনিক কবি কেউ-কেউ বাড়িতে যারা মা'র সঙ্গে বাঙাল ভাষায় এবং কলেজে কফিহাউসে খালাসিটোলায় বা বেশ্যার সঙ্গে ক্যালকেশিয়ান ডায়ালেক্টে কথা বলেন --- তাঁরা সুবিমলের ভাষারীতিকে প্রচণ্ড আক্রমণ করেন--- কিন্তু ২১শে ফেব্রুয়ারির শহিদরা যেমন একই সঙ্গে শ্রদ্ধেয় সেইমত সুবিমল বসাকও শিক্ষিত কবি-সাহিত্যিকদের উপহাস-গালাগালের গ্লোরিকে ম্লান করে দিয়ে একই ভাষারীতিতে লিখে চলেছেন (১৯৬৪ থেকে)--- লিখে চলবেন।
সুবিমল গদ্য লেখেন এবং কবিতাও --- সুবিমল রবীন্দ্রনাথের মত দাড়ি রাখেন না কিন্তু টাইপমেশিনের সাহায্যে অই ভদ্রলোকের একটা প্রতিকৃতি তৈরি করেছিলেন ছাত্রাবস্হায়--- দেখেছিলুম। সুবিমল রবিঠাকুরের মত গান বা নাটক লেখেননি কোনোদিন, সো হোয়াট ? রবীন্দ্রনাথ না থাকলে সুবিমল লিখতেন কি ? বিশেষত বাঙাল ভাষায়, উপরন্তু যখন দু'বাংলাকে কেন্দ্র করে পাবলিশাররা তাদের পড়ে যাওয়া মার্কেটকে পুনরায় তোলবার চেষ্টা করছে, তখন লক্ষ্য করে দেখুন, সুবিমলের 'বাংলাদেশ' নামে বাঙাল ভাষায় লেখা লিফলেটটিতে কত কম বঙ্গবন্ধু বা বাংলা-দেশ-এর রেফারেন্স।

আরশির ওই পারে ফুটছে শয়তানের চ্যারা
ফিরে-ফিরে প্রতিশোধ লিতে তেইড়্যা আহে
আমার উল্টাহান'ই আমি নিত্যি দেহি আরশিতে

---মাইকেল মধুসূদন দত্ত, যিনি বাঙালি খ্রিষ্টান ছিলেন, তিনি রাবণের ভেতর দেখতে পেয়েছিলেন --- আপন আত্মার ছায়া --- অনুরূপভাবেই সুবিমল ভগবান-বন্দনা করেননি--- শয়তানের ভেতর দেখেছেন নিজস্ব প্রতিবিম্ব--- কিন্তু এর ফলে যদি কেউ বলে, আর দেখতে হবে না --- ও শালা নিশ্চয় মধুসূদন দ্বারা প্রভাবিত, তখন ত্রাহি মধুসূদন ডাক ছাড়া গত্যন্তর আছে কি ? উপনিষদেও বলা হয়েছিল তিনি আছেন --- রবীন্দ্রনাথও বুঝে ছিলেন ব্যাপারটা--- রবীন্দ্রনাথও কি উপনিষদের চর্বিতচর্বণ ? ব্যাপারটা বলতে হল এই কারণে যে আধুনিক গদ্য-পদ্য'র আন্দোলন-এ (সত্য গুহ লিখিত) পট করে লিখে দেয়া হয়--- অমুক-অমুক কবিরা তমুক-তমুক কবিদের চর্বিত চর্বণ করে কবিতা লিখে চলেছেন। কবিতা লেখা ব্যাপারটা নোট মুখস্হ করে এম.এ. ডিগ্রি পাওয়ার মত সহজ নাকি, যে আশুবাবু গোপালবাবু সুকুমারবাবু ইত্যাদির থিওরি-থিসিসের চর্বিত চর্বণ করলেই বভিষ্যতে অধ্যাপক হওয়া বা হায়ার সেকেণ্ডারি স্কুলে বাংলা পড়ানো যাবে।
সুকুমার টের পেয়েছেন--- ব্যর্থতা নিয়া থাকায়ও কারু-কারু সার্থকতা... হেজেহুইতে ট্যার পাই --- কতো-কতো ব্যাপারে ম্যায়ালোকেরে কাৎ কইরা ফেলে বাজারের মাগি। সুবিমল দেখেছেন---

এই শহরের মাগিদের কোঠায় দেহি সরকারি 'নিরোধ'এর বিজ্ঞাপন
কালোবাজারের খয়রাতি দানে না-জানি কতো মন্দির তৈয়ার হইতাসে
এই কিনারে বোমা পরীক্ষা --- আরেক কিনারায় হাসপাতাল

সুবিমল লিখেছেন---

সুখি মানুষেরা একতলা দুইতলা কইরা  উইঠ্যা যায় উপরে
হাতের লাগল থাকে ম্যায়ামানুষ চেনবান্ধা কুত্তা, আদালতের আইন-কানুন

এভাবে সুবিমল যা-কিছু টের পেয়েছেন দেখেছেন সবকিছু লিখে রেখে গ্যাছেন, এমন কি শেষ কবিতার প্রথম দুই লাইন---

ভিয়েৎনামের উপর আমারিকার যুদ্ধনীতি সবরাষ্ট্রের অসমর্থন
অহনই শোওনের তোড়জোড় করতাসো, রাত্র হপায় পড়লো--

এভাবেই বাংলাদেশ আন্দোলনের জোয়ার আসার আগে থেকেই পদ্মাপারের ছেলে সুবিমল দ্যাশের ভাষায় গদ্য লিখে বিদেশে পরিচিত হয়ে গেছে, এখন আমরা যারা খুব বাংলাদেশ নিয়ে লেখালিখি মাতামাতি সভাসমিতি করি, তারা যদি সুবিমল-এর ভাষারীতিকে আক্রমণ করি বা এ-সম্পর্কে উদাসীন থাকি তবে সেটা একটা পাপের পর্যায়ে গিয়ে পড়বে...

( কিন্তু পত্রিকায় প্রকাশিত, ১৯৭১)   

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন