রবিবার, ৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১১

প্রত্নবীজের সন্ধানে

অধ্যাপক অলোক রায় লিখিত

প্রত্যেক বছর পুজোসংখ্যায় কতগুলি উপন্যাস ছাপা হয় তার হিসেব জানা নেই। দশ-বারোটি বাজারি পত্রিকায় সম্ভবত শ'খানেক উপন্যাস বের হয়। এ ছাড়া তথাকথিত ছোট পত্রিকাতেও আজকাল উপন্যাস থাকে বা উপন্যাসোপম গল্প। এত যে লেখা হয়, তার মধ্যে মনে দাগ কাটে এমন উপন্যাস সংখ্যায় নগণ্য। অ্যাকাডেমিক বিচার এখন শিকেয় তোলা থাক, সাধারণ পাঠকের প্রতিক্রিয়ার কথাই বলছি। উপন্যাসের শিল্পরূপ নিত্য পরিবর্তমান। নিটোল পরিপুষ্ট ইচ্ছাপূরণের কাহিনী আজও লেখা হয়। ভোগ্য পণ্যের মত বিজ্ঞাপনের কল্যাণে এ ধরণের গল্প হয়তো জনপ্রিয়ও বটে। তা না হলে বাজারি পত্রিকা এমন উপন্যাস ছাপে কেন ? কিন্তু বাজার দখল করার প্রত্যক্ষ অভিপ্রায় ছাড়াও উপন্যাস লেখা হয় ।তাকে যথার্থ উপন্যাস বলা যাবে কি না তা নিয়েও সংশয় থাকতে পারে। তবু এর দরকার আছে । এমন কিছু কথা বলতে হয়, যা এতদিন কবিতাতেই বলা হয়েছে। কিংবা প্রবন্ধে। এমন উপন্যাসের আধারে পরিবেশ করা হলে আপত্তির কিছু নেঈ। উপন্যাস মিশ্রশিল্প। উপন্যাস খুবই নমনীয় সহজবশ্য শিল্পরূপ। তবে উপন্যাসের অনেক পরিবর্তন সত্বেও তার সঙ্গে বাস্তব অভিজ্ঞতার একটা যোগ অস্বীকার করা যায় না। সমস্যা যদি কিছু থাকে তা হলো বাস্তবের স্বরূপ-সত্য নিয়ে।
সুবিমল বসাকের প্রথম উপন্যাস বা গদ্যন্যাস ছাতামাথা   (১৯৬৫) আমি পড়িনি । দ্বিতীয় উপন্যাস প্রত্নবীজ (১৯৯৬) কয়েক বছর আগে ছাপা হলেও সদ্য আমি পড়বার সুযোগ পেয়েছি। উপন্যাস, কিন্তু আদৌ অবসর-বিনোদনের সামগ্রী নয় । পড়ে চমকে উঠতে হয় । কারও ভালো লাগবে, কারও লাগবে না, এটাই স্বাভাবিক। তবে অগ্রাহ্য করা অসম্ভব। একটা প্রবল আলোড়ন তোলা সম্ভব। অথচ সেভাবে আলোড়ন সৃষ্টি করেনি। এটাই বিস্ময়কর। অথবা বিস্ময়ের কিছু নেই। প্রত্যেক বছর বাংলায় যে একশো-দেড়শো উপন্যাস বেরোচ্ছে, তার নিশ্চয় বিশেষ একজাতের ভোক্তা আছে। তাঁরা প্রত্নবীজ পড়তে উৎসাহ বোধ নাও করতে পারেন। 
ঠিক কার্যকারণ জানি না। তবে একটা আশঙ্কার কথা জানিয়ে রাখি। ছয়ের দশকের গোড়ায় হাংরি জেনারেশন নামে যে বুলেটিন বেরিয়েছিল, এবং তারপর এই নামে ক্ষুধার্ত প্রজন্ম নামে যে-সাহিত্যান্দোন প্রসার লাভ করেছিল, তার স্রষ্টা ছিলেন মলয় রায়চৌধুরী। এই পত্রিকার যে-সংখ্যায় (অষ্টম সংখ্যায়) সুবিমল বসাকের লেখা ছাপাহয়, সেই সংখ্যাটি অশ্লীলতার দায়ে আদালতে অভিযুক্ত হয় (অবশ্য তাঁর লেখার জন্যই এমনটা ঘটেছিল তা নয়)। মলয় রায়চৌধুরীর জেব্রা (১, ২) পত্রিকায়  (১৯৬৫, ১৯৬৭) সুবিমল বসাকের গেরিলা আক্রোশ আর জাবড়া ছাপা হয়। সুবিমল বসাক ''নিয়ন্ত্রিত" আর একটি পত্রিকার কথা জানা যাচ্ছে-- প্রতিদ্বন্দ্বী, তাতে ছাপা হয় সুবিমল বসাকের বেশ কয়েকটি গদ্যরচনা-- যেমন, প্রতিবিম্ব, আগ্রাসী অপকর্ম, মেরামতহীন ফাটল  প্রত্নবীজ বইটির শেষে মলয় রায়চৌধুরীর সংযোজন সেই পুরনো যোগসূত্রের কথা মনে করিয়ে দিল। 'ব্রিটিশ রাজত্বের কুষ্ঠে বাঙালির পচনশীলতা ও অবক্ষয়' বা বাঙালির মধ্যে লভ্য 'ব্রিটিশ রাজত্যের ফেলে যাওয়া মূল্যবোধ' ইত্যাদি প্রসঙ্গ উপন্যাসব্যাখ্যায় কতটা সাহায্য করে, সে বিষয়ে সংশয় আছে।মলয় রায়চৌধুরী দাবি করেছেন প্রত্নবীজ হলো 'সাবঅলটার্ন উপন্যাস'। হয়তো তাই। নিম্নবর্গের মানুষের ইতিহাসের ধারণা পেয়েছি গ্রামশির রচনায়। ভারতবর্ষেও অধুনা সাবঅলটার্ন ইতিহাস লেখা হচ্ছে, লিখছেন রণজিৎ গুহ, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, গৌতম ভদ্র  ও অনেকে। কিন্তু সাবঅলটার্ন উপন্যাস? ফরাসি ঐতিহাসিক ইমানুয়েল ল্য রোয়া লাদুরীর 'মঁতাইউ'কে নিয়ে লেখা বইটি উপন্যাস নয়, উপন্যাসের আকর-গ্রন্থ বলা যেতে পারে। একালে আমরা যাকে 'আনাল' (Annales) বলছি, তার মধ্যে ইতিহাসের বড় সময় থেকে ছোট সময়ে নেমে আসার প্রয়াস মেলে। এইখানে ঐতিহাসিকের সঙ্গে সাংবাদিকের মিল ও অমিল।অশীন দাশগুপ্তের  ভাষায় "ঐতিহাসিক অতীতকালের সাংবাদিক এবং সাংবাদিক বর্তমানের ঐতিহাসিক"। সুবিমল বর্তমানের ঐতিহাসিক । তাঁর লেখার বিষয় অচিরকালের মধ্যে ইতিহাসে পরিণত হবে, হয়তো ইতিমধ্যেই হয়েছে। এদিক থেকে তাঁর রচনা 'আনাল-ধর্মী' হতে পারে, কিন্তু হাংরি জেনারেশন  বা সাবঅলটার্ন সাহিত্যের প্রসঙ্গ প্রত্নবীজের আলোচনায় না আনাই ভালো। মলয় রায়চৌধুরীর সংযোজন ( "সুবিমল বসাক অমন অঢেল যুক্তিহীনতাকে পাঠকের সোপর্দ করেছেন"), এবং প্রচ্ছদের লেখক পরিচয় এদিক থেকে কিছুটা বিভ্রান্তিকর ("সাবঅলটার্ন এই উপন্যাস বস্তুত শ্রেণী-সংগ্রামের চেতনায় উজ্জীবিত")।
কাহিনীর সূচনায় লেখক স্হান-কাল-পাত্রের নির্দেশ দিয়েছেন -- "বাংলার বাইরে গড়ে ওঠে বাঙালিদের নিজস্ব ঘরানার এলাকা। এই সব বাঙালিরা মিশে গেছেন বিভিন্ন রাজ্যের ভূমিপুত্রের সাথা। ভাষা, সংস্কৃতি সব গ্রাস করে মিলিয়ে গেছেন তাদের মাঝে। সে জীবন, যে বাংলাভাষা, সে সংস্কৃতি বাঙালির, তবু তা অন্যরকম।... তাদের যে কী ইতিহাস তা কেউ জানে না। এই রচনাটি সেই সব মিথের গল্প।" কাহিনী তাই ইতিহাসও বটে। অবশ্য এখানে ভুল বোঝার একটু সম্ভাবনা আছে। বিহারের রাজধানির কোনো এক মহল্লায় বসবাসকারী বাঙালিকে নিয়ে উপন্যাস লেখা সুবিমল বসাকের উদ্দেশ্য ছিল না। প্রবাসী বাঙালি মধুবাবুর আট-ন' বছরের ছেলে, বাঙালি মাইজি 'খোকা কে মাই', আর খোকার ঠাইনি কেন্দ্রে আছে বটে, তাদের চোখ দিয়েই হয়তো লেখক দেখেছেন প্রতিবেশী ভগযোগিনী আর তার স্বামী হালওয়াইয়ের দোকানদার রামখেলাওনকে। সেই সঙ্গে এসেছে দুলহানিয়া বাতাসিয়া, কচরি-ফুলৌরি দোকানের তেতরি, মোদির দোকানের নগীনা, কাজের মেয়ে সুগিয়ার মা, বিপৎ গোপ, ফেকন চামার, খোটন আর বুলকন, বুধনি ডাইনি। "চারোওর মহল্লার গোয়ালা, কাহার, কুর্মি, কুমহার, ধানুক, দোসাদ জাতের ভিড়।" এর মধ্যে মুনেশ্বরবাবু, নাগেশ্বর পরসাদ, বিন্ধেশ্বরী সিং, রামাধারীর মতো অর্থবান মানুষ দুচারজন আছেন, কিন্তু প্রত্নবীজ  যেমন প্রবাসী বাঙালীর কাহিনী নয়, তেমনি লালা-কায়েতদেরও কাহিনী নয়।
মলয় রায়চৌধুরী জানিয়েছেন, "পাটনা শহরের কয়েকটি পাড়াকে এই সাবঅলটার্ন শ্রেণী দিয়েছেন তাঁদের বহুল প্রচারিত খ্যাতি। ঐ পাড়াগুলির মধ্যে থেকে সুবিমল বসাক বেছে নিয়েছেন লোদিপুর নামের কুখ্যাত লুমপেন প্রলেতারিয়েত পাড়াটি।" এই পাড়ায় ভূমির সঙ্গে সম্পর্কহীন কাহার কোয়রি ডোম চামার দুসাধ মুসাহার হাজাম ধোবি বড়হি ক্রমশ একাকার । কিন্তু যেসব মানুষগুলির দেখা মিলল উপন্যাসে, তারা কেউ কুখ্যাত লুমপেন প্রলেতারিয়েত বলে মনে হয় না। বিপৎ গোপ ও তার চ্যালাচামুণ্ডাদের চোর-ডাকাতেরা ভয় পেতে পারে, কিন্তু দাঙ্গা হাঙ্গামা করে বেড়ানো তাদের পেশা নয়। অন্যদিকে এরা প্রায় কেউই নির্বিত্ত সহায়সম্বলহীন নয় । এদের নিজেদের একটা সমাজ আছে ( মুসহর শুধু অস্পৃশ্য নয়, তার জলের ছিটে লাগলে এদের 'জাত' যাবে)।সেখানে বহুল প্রচারিত প্রথানুগত্যের সামাজিক ও পারিবারিক রীতিনীতির কেউ বিরোধিতা করে বলে মনে হয় না। কাজেই ঠিক বোঝা গেল না কীভাবে "একটি পাড়ার সকলেই আধুনিকতার একাধিক রোগে ভুগছে এবং তার মধ্যেই গড়ে উঠছে বহুমুখী ঐক্যের প্রবণতাগুলি, যেগুলি আধুনিকতাকে ছাপিয়ে বা ডিঙিয়ে একটি নবতর নৈতিকতা ও বৈধতার জন্যে উন্মুখ।"
কেউ-কেউ আজ এমনকথা বলছেন, উপন্যাস মাত্রই ঐতিহাসিক, উপন্যাস মাত্রই আঞ্চলিক।সুবিমল বসাক সচেতনভাবে ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখেবেন বলে উপন্যাস লেখেননি ( তবে 'ইতিহাসের' কথা তাঁর মনে ছিল ) । পরিবর্তমান সমাজে বিশেষ একটি অংশের অনুপুঙ্খ বর্ণনা ইতিহাসের সামগ্রী -- বর্তমানের কাহিনী হলেও তা ইতিহাস। বিশেষত ভাষা ব্যবহারে আঞ্চলিকতাকে যেভাবে কাজে লাগানো হয়েছে, তা বিস্ময়কর। ঢোঁড়াইচরিতমানস-এ সতীনাথকে টীকা-টিপ্পনীর আশ্রয় নিতে হয়েছিল। আলাউদ্দিন আল আজাদের কর্ণফুলি উপন্যাসে চট্টগ্রামের ভাষাব্যবহার চমকপ্রদ লেগেছিল একসময়। কিন্তু সশেষ পর্যন্ত চরিত্রকে ফোটাবার প্রয়োজনেই বিশেষ ভাষা ব্যবহার । তা না হলে অপরিচিত মহল্লা, ততোধিক অপরিচিত মানুষজন, আর তাদের ভাষাকাঠামোতে পাটনাইয়া বুলি প্রয়োগ -- অপরিচয়জনিত বিস্ময়রস সৃষ্টিতে সক্ষম, কিন্তু উপন্যাস হিসেবে স্বতন্ত্র মর্যাদা দাবি করতে অক্ষম। প্রত্নবীজ  নানা কারণে অসামান্যতা দাবি করে, কিন্তু ভুল জায়গায় জোর দিলে উপন্যাসের ভ্রান্তপাঠের সম্ভাবনা বাড়ে। 
অবশ্য সাহিত্যের পাঠ-পাঠান্তর থাকতেই পারে। কাকে বলে যথার্থপাঠ আর কাকে বলে ভ্রান্তপাঠ -- নিঃসংশয়ে কখনই বলা সম্ভব নয়। আমি আমার নিজের মত করে প্রত্নবীজ পড়েছি। আমার প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে আর একজন পাঠকের অমিল হতেই পারে। তবে সুবিমল বসাকের অভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষণশক্তি ও ভাষা ব্যবহারে নৈপুণ্য নিয়ে কোনো প্রশ্নই উঠতে পারে না। কাহিনীর প্রেক্ষিতের সঙ্গে ভূচরিত্রের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে---

 ওদিকে নালা রোড, করবিঘাইয়া, এদিকে মন্দিরি রাজাপুর, মানপুরা, চিৎকোহরা-- এলাকা জুড়ে সার-সার মাথা, তালগাছের। ফাঁকা মাঠে দাঁড়ালে তাড়বন্না যেন মেঘের মতো আকাশে লেপ্টে।
লোদিপুর গয়া রোড দোকানে দোকানে ঢিবরি আর পঞ্চলাইটের রোশনী। ফেরার পথে--- পটনা-গয়া রোডে গঙগা আস্নান যাত্রিদের পায়ের ্অহত আওয়াজ শোনা যায়। এদিকে মিশনারি স্কুলের উল্টোদিকের বস্তি থেকে লোদিপুর, এ.আর.পি., ব্যাঙ্ক রোড, তিমোহানি, বাঁশঘাট, মন্দিরি -- যত সব ছেলে-জওয়ান লোক আছে, রাম নামে ছড়াছড়ি।
চারোওর লোকজন, পহেলবান, মুসাফির। দুদিকে রিক্সা, বৈলগাড়ি, সাইকেল, টমটম, ফিটন। আনা-জানা বন্ধ।
পাক্কি সড়কের কিনারে, মিশনারি ইস্কুলের পাশেই, বিপৎ গোপের ভাড়ি খাটাল। রাস্তার ধারে ইঁটের দিওয়ার, ভেতরে খাটাল। বাঁশের বাল্লায় খাড়া করা ছাউনি -- পুয়াল-খড়ের ওপরে খপরৈল --- অনেকখানি এলাকা জুড়ে। বিপৎ গোপের অখাড়া পটনাভর মশহুর।

আবার ভৌগলিক অবস্হানের সঙ্গে মিলিয়ে রচিত হয় চরিত্রের মুখের ভাষা। ভগযোগিনী বা রামখেলাওন, সুগিয়ার মা বা বিপৎ গোপ যে-ভাষায় কথা বলে, তাকে হিন্দি ভাষার নিদর্শন বললে ভুল হবে।'বাংলা ভাষাকাঠামোতে পাটনাইয়া বুলি প্রয়োগে' বাংলা কথাসাহিত্যে অভিনব সামগ্রী। আসলে হিন্দিভাষী মহল্লার মানুষজন ঠিক যে-ভাষায় কথা বলে, আগাগোড়া  তার ব্যবহার কাহিনীর পক্ষে গুরুভার হয়ে উঠত। 'খোকা-কে-মাই' হিন্দি বাংলা মিশ্র ভাষায় কথা বলবে সেটাই স্বাভাবিক, কিন্তু ভগযোগিনীও অনেক সময়ে সেই ভাষা ব্যবহার করে -- 

হ্যাঁ রে, কাল রাতে কান্না করছিলি কাহে?
আমাকে বহুত পিটেছিল--
পিটেছিল ? কাহে ? নিশা-ভাঙ করেছিল নাকি?
নেহি খোকা-কে মাই। ওকরে আদত এহি। ঐসে ঐসে পিটেছিল--
সে কি ? তোর লাগেনি ? খুব চেল্লামিল্লি করছিলি যে --
উ তো ঐ সেহি রোনা করেছিলাম।

মাঝে-মাঝে মিশ্র ভাষার বাংলা রূপান্তর [মৌগিঅনকে সামনে সরম কৌচিকা -- (মেয়েদের সামনে আবার লজ্জা কিসের!) কা বাত হ্যায় ? ব্যাপার কি ? ববন্ডর হো গয়া -- (সাংঘাতিক ব্যাপার), কখনও বন্ধনীর মধ্যে অর্থনির্দেশ (দিবালি -- দেউলিয়া)] বর্ণনা অংশে সাধারণত বাঙালির মুখের ভাষাই ব্যবহৃত হয়েছে, হয়তো মাঝে-মাঝে উদ্ধৃতিচিহ্ণের মধ্যে হিন্দি দুচারটি কথা--

যেই যায়, পণ্ডিতজি তার মাথায় লাগিয়ে দেয় ফাগের টিকা। তারপর গোটা মুখমণ্ডলে, ক্রমশ হাতে-পায়ে, পেটে। আবির মাখালে নাকি 'মাতামৈয়া' ( মানে মা শেতলা, অর্থাৎ বসন্ত)হয় না।
ঘাস-নেওয়ারির তৈরি হোলিকা, চারিদিক ঘিরে জড়ো করা তুম্বাকার গোইঠা, কাঠ-বাঁশ, টায়ার, কাগজ, শুকনো পাতা -- সব কিছুতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে বাচ্চা-জোয়ানরা বসে থাকে দূরে। আগুনের লকলকে আলো, ফটাফট আওয়াজ আর সেই সঙ্গে কালো ধোঁয়া মিশে যায় আকাশে বাতাসে। পোড়া গন্ধে ভরে যায় পরিবেশ। বাচ্চা-জোয়ানরা শিকে কাঁচা আলু একটা-তিনটে-পাঁচটা-সাতটা গেঁথে ছুঁড়ে ফেলে আগুনে । দহন শেষে ছাই উড়িয়ে শিক খুঁজে-বেছে বার করে আনো পোড়া আলু, হাতে-হাতে বিলি হয় পরসাদি।

প্রত্নবীজ-এ প্রচলিত উপন্যাসের নিটোল কাহিনীবৃত্ত প্রত্যাশা করে লাভ নেই। সুবিমল বর্তমানের ঐতিহাসিক, তাই তাঁর রচনায় কিছুটা সাংবাদিকতার ধরন এসেছে। পনেরোটি পরিচ্ছেদে মহল্লের নানা ধরনের মানুষ এসেছে। কারও জীবনের আদ্যন্ত কাহিনী বর্ণন লেখকের উদ্দেশ্য নয়। হয়তো ন'বছরের খোকার চোখ দিয়ে দেখা হয়েছে বলে তাকে কাহিনীর যোগসূত্র বলা যেতে পারে। কিন্তু সব জায়গায় সেও নেই, বা তার চোখ দিয়ে সব কিছু দেখাও হয়নি। বুধনি কিংবা ফেকন কিংবা বুলকনকে নিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছোটগল্প রচনা সম্ভব ছিল। কিন্তু সুবিমল বসাকের ঝোঁক ব্যক্তিচরিত্র নয়। অশীন দাশগুপ্ত  যাকে বলেন ব্যক্তিসময়, তার ব্যবহার সেভাবে ঘটে না। বড়সময়ের উল্লেখ দুএক জায়গায় আছে, কিন্তু কালনির্দেশ কাহিনীকারের উদ্দেশ্য নয় --  "এক জমানা ছিল, যখন অংগ্রেজ সরকারের খুফিয়াসিআইডিরা তার ওপর নজরদারি করত। কত লাখো-লাখো নওজয়ান তাঁর গানা শুনে সুরাজি দলে ভিড়ে্ছে, ভারি রকম চাঁদা দিত সুরাজি দলে।"  ছোটসময়  নিয়েই প্রত্নবীজ-এর কথাকারের কারবার । তাই 'তাড়ি নয় বৈশাখি', বাতাসিয়ার শাদির প্রস্তুতি থেকে গৌনা, মাঝে-মাঝে রঙিন ফেরিওয়ালা, হালওয়াইয়ের নজারা, তেল মালিশ, অখাড়াবাজি, মাদারিঅলার করিশমা -- এই সব নিয়ে মহল্লার বিচ্ছিন্ন চিত্রের মধ্য দিয়েই পূর্ণ চিত্র ফুটে ওঠে। উৎসব-অনুষ্ঠান বর্ণনার মধ্যে কাহিনীর ভাবৈক্য সন্ধান করলে একেবারে ভুল হবে না।

বছরভর কত তোহার-পরব-- ছট, কার্তিক পূর্ণমাসি, দশহরা, দিওয়ালি, পুষ-সংক্রান্তি, হোলি, তীজ, কর্মা, বৈশাখি, গোবর্ধনপুজা, চিত্রগুপ্তপুজা -- এছাড়েও সৎনারানজীর কথা, অখণ্ড সংকীর্তন । কিন্তু হোলি আর দিওয়ালির মতো এমন জমকালো পরব নেই। দশহরাও তেমন করে মানায় না। হোলি হচ্ছে বসন্ত ঋতুর পরব-- জওয়ানি ও মিলনের উৎসব; দিওয়ালি হলো রোশনাইয়ের, লছমি-পুজন। গোবর্ধনপুজা  -- গোয়ালা আহিররা করে, বিপৎ গোপের অখাড়ায় খুব ধুমধাম করে উৎসব মানায়, পুজাপাঠ, গানা-ঢোলক, কুস্তি-দাঁও-পেঁচের নুমাইশ চলে। চিত্রগুপ্তপুজা -- দিওয়ালির পর স্রেফ লালা-কায়েতরা। এই দিনে লালারা কোনো লিখা-পঢ়ির কাম করে না, কলম ছোঁয় না। লাখ জরুরত থাকলেও এক অক্ষরও লিখবে না-- মানিঅর্ডার, কর্জ-পর্চা, ডাক্তারি নুস্খা--- কোথাও না। ছট পরব চলে মাহিনা ভর; সুরজ দেওতার পূজা, গঙ্গার কিনারে অস্হায়ী ঝোড়ি। খুব নিয়ম আচার।

হোলি আর দিওয়ালির কাহিনীরূপ সুসম্পূর্ণ। বিহারিদের জীবনচিত্র অবলম্বনে সাংবাদিক অসামান্য সংবাদ-বিচিত্রা রচনা করতে পারেন। কিন্তু সুবিমল বসাক সাহিত্যিক --- তাই নিরুদ্দেশ সংবাদ বা চমক সৃষ্টির প্রয়োজন খাসখবর রচনা তাঁর উদ্দেশ্য নয়। তিনি অঞ্চলকে অবলম্বন করে অঞ্চলের মানুষ, অঞ্চলের মানুষকে অবলম্বন করে হাশাআকাঙ্খাময় জীবনের গভীর সত্যকে ধরতে চান।
ভূমিপুত্রদের সঙ্গে বহিরাগত বাঙালিদের মিলে-মিশে থাকারই কথা। মহল্লায় কয়েকঘর বাঙালির কথা বলা হয়েছে --- খোকা, খোকা-কে-মাই, 'পঢ়ালিখা আদমি খোকার বাবা, ঠাইনি, মিউনিসিপালিটির ট্যাক্স কালেক্টর চিন্তাহরণবাবু, বাঙালি মাস্টারিনিজি আর তার মর্দ। এরা পরিপার্শ্বের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছে নিজেদের। অবশ্য দূরত্ব থেকেই যায়। আর এই দূরদৃষ্টি থেকে প্রত্নবীজ লেখা। মাস্টারিনিজির মর্দের কয়েকদিন তবিয়েত আচ্ছানেই, ঘরেই বসে আছে, "মাথা টনটনায়, পায়ের তলহটি গরম।" কতক্ষণ আর কিতাব পড়া যায়। তাই "মাঝে-মাঝে খিড়কি দিয়ে আসমান দেখে, পঞ্ছি দেখে, বাদল দেখে, দুরে মকান, মাটির বাড়ি, খাপরার ছাদ, আঙ্গন-ওসারা দেখে।" দু-মঞ্জিলার ওপর থেকে দেখে রামখেলাওণকে তেলমালিশ করে ভগযোগিনী ।--- "মাস্টারিনিজির মর্দের নজর ধুঁধলে যায়, কপালে জোর দরদ মহসুস হয়। চুপচাপ কুর্সিতে শরীর এলিয়ে শুয়ে থাকে। হাত থেকে কখন যে কিভাবে পড়ে যায়, পতা তক চলে না তার।" প্রত্নবীজ  পড়ার প্রতিক্রিয়া আমারও অনেকটা এই রকমই --- পিছনে ফেলে আসা এক জীবন, তার দিকে সতৃষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা, সেখানে আর ফিরে যাওয়া যাবে না। খোকা তো চিরকাল ন'বছর বয়সেই থাকবে না!
(কালিমাটি পত্রিকা, ফেব্রুয়ারি, ২০০১)   

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন