বুধবার, ৯ ফেব্রুয়ারী, ২০১১

অজয় সেন লিখিত 'হাবিজাবি, বকবকানি ও খোলা জানলা'

সুবিমল বসাকের সাথে প্রথম আলাপ কলেজ স্ট্রীটের 'বিভূতি কেবিনে'। সেখানে শৈলেশ্বর, বাসুদেব, সুভাষ অনেকেই আসত, কাছাকাছি কফিহাউস থাকা সত্তেও 'বিভূতি কেবিন' তাদের অনায়াসে সাঁতরানোর জায়গা ছিল।১৯৬৩-৬৪-এর ওই  আড্ডাখানায় শুনতাম বেশি, লক্ষ্য করতাম বেশি হাংরির নব্যযুবকদের, এদের মধ্যে আমার কাছে আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ছিল বাসুদেব দাশগুপ্ত ও সুবিমল বসাক। পরে সুবিমলের সঙ্গে অন্তরঙ্গতার কারণে এক ধরণের ভালোলাগা জন্ম নিয়েছিল, বলা বাহুল্য, আজও যা চিড় খায়নি এতটুকু। ওর অফিসে গিয়ে অনেক দিন অনেক সময় কাটিয়েছি, ডিপার্টমেন্টের প্রত্যেকটি কর্মচারীর নাম. কে কি রকম, কার কি দুর্বলতা, কি কি গুণ খুঁটিনাটি আমাকে সে বলত নিচুস্বরে, চা খেতে-খেতে এই সব গল্প হত আমাদের। আর যে আলোচনার মধ্যে এসব কিছুই থাকত না, তা হল লেখালিখি। সে নিজেরই হোক বা অপরেরই হোক। বিশেষ করে অপেক্ষাকৃত তরুণদের লেখালিখি সুবিমল বেশ মনোযোগ দিয়েই পড়ত, যেটা আমার তাকে ভালো লাগার কারণ। কে কোথায় একটা ভালো লেখা লিখেছেন, সেই লেখার সমালোচনা করে ভালো কি মন্দ অনায়াসে জানিয়ে দিত। আমার লেখা যে সে পছন্দ করে তা প্রথম দিন আলাপের পরই জানিয়েছিল, অবাক হয়েছিলাম বেশ খানিকটা। মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন হয়েছিলাম এই কারণে সদ্য লিখতে আসা নব্য যুবককে উৎসাহ ও প্রচ্ছন্ন সাহস যোগানোর জন্য।
সুবিমল বসাক প্রকৃত অর্থে ছাই-চাপা আগুন। সে সময় হাংরি আন্দোলন ঝড় তুলেছিল দেশে তো বটেই, বিদেশেও তার ঝাপটা লেগেছিল, সে সময় পুতু পুতু রক্ষণশীলরা চেঁচামেচি শুরু করেন, ফলতঃ শ্লীল-অশ্লীল সাহিত্য রচনা করেছেন, সমাজের ভেজানো দরোজা একের পর এক খুলে দিচ্ছেন, তাদের এসব উদ্যম চিন্তাভাবনা ভালো লাগেনি প্রশাসন এবং এক শ্রেণীর ব্যাঙদের কাছে, ফলতঃ ধরপাকড়, হাজতবাস, কোর্টকাছারি অমোঘ হয়ে নেমে আসে হাংরি আন্দোলনের কবি-সাহিত্যিকদের ওপর। এদের মধ্যে অনেকে,( যেমন শৈলেশ্বর ঘোষ, সুভাষ ঘোষ ) মুচলেকা দিয়ে দেন, ভাবটা এমনই যে ওপাড়ায় আমি নেজে যাইনি, আমাকে ওরা নিয়ে গেছিলো। সুবিমল ও অন্য কয়েকজন নিজেদের মতই লেখালিখি করে গেছেন। কাউকে, কোনো কিছুকে তোয়াক্কা না করেই। সুবিমলের লেখার মধ্যে একটা প্রাদেশিক সাযুজ্য লক্ষ করি। গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ যেমন লিখেছেন, পাশাপাশি প্রাদেশিক কবিতা অনুবাদ এবং জীবনীগ্রন্হ রচনাতেও মাহিরিআনা দেখিয়েছেন। দুটো উপন্যাস, ছয়টি গল্প-গদ্য সংগ্রহ, দুটি কবিতার নিজস্ব চটি বই।প্রবন্ধ অনুবাদ করেছেন অনেক। অনুবাদ সাহিত্যে ২০০৭ সালে যশপাল রচিত অকাদেমি পুরস্কারে ভূষিত সুবিমল। যদিও তা অনেক আগেই পাওয়া উচিত ছিল।
সুবিমল বসাকের লেখালিখি --- প্রথম কবিতার বই 'হাবিজাবি' যখন প্রকাশিত, তখন হাংরি আন্দোলন তুঙ্গে। অধিকাংশ কবিতা ওই সময়ের লেখা, মনে হয় নিজের সম্পর্কে ভাবনা, সমাজের উঠোনে নিজেকে নগ্ন করে খতিয়ে দেখা, নিজের পরিবেশকে খুঁড়তে-খুঁড়তে নিজের সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিকোণ, ভাবনা আবিষ্কার করা। ফলতঃ কবিতাগুলোয় প্রেম-অপ্রেম, ভালোবাসা-ভালোবাসাহীনতা, চোরাস্রোতের মত চিন্তা, ঈর্ষা, স্নেহ, জীবন-পারাপার-ভাবনা, দুঃখকষ্ট, অবজ্ঞা-উপহাস, হতাশা, চিল-চিৎকার যাবতীয় ব্যাপার উঠে এসেছে ওই কবিতাগুলির মধ্যে।
আমি কবিতা পড়তে ভালোবাসি। কবিতার প্রতি আমার যথেষ্ট দুর্বলতা আছে, তো যেটা লক্ষ করি, 'হাবিজাবি' কবিতার বইয়ের মধ্যে, তা হলো ভাষা। সুবিমলের কথায় --- আমার মায়ের ভাষা। পূর্ববাংলার ভাষা তো মাটির ভাষা। এখন লক্ষনীয় 'মা' কোন অর্থে? দেশ-মা না গর্ভধারিণি-মা ? এক অদ্ভুত দেশজ কধ্য ভাষায় এরকম লেখা আমি কখনও পড়িনি। বাংলা সাহিত্যে কবিতার জগতে সুবিমল পাথ-ব্রেকিং।
১৯৭০ থেকে ২০০০ সালে প্রায় তিরিশ বছর বাদে দ্বিতীয় কবিতার বই 'বকবকানি' । মোট চব্বিশটি কবিতার চটি বই। রাজনীতি, ব্যাঙ্গ, যৌনতা, দার্শনিক স্ট্রিট রিয়্যালিটির পাশ কাটিয়ে এক মানভাষার আকুতি। 'বকবকানি' সে-অর্থে এক সার্থক দলিল। অবশ্য হাংরি আন্দোলনের বাঁকবদল ছিল উত্তরঔপনিবেশিক এপার-বাংলার ফসল। সমাজ তার নিজস্ব প্রক্রিয়ায় যে জীবনবোধ গড়ে দেয়, তা থেকে এই মোড়বদল আলাদা করা যায়। কবিতা ছাড়াও সুবিমল বসাক অত্যন্ত নিপুণভাবে গদ্য রচনা করেছেন; গদ্য সংগ্রহ যে কয়টি হাতে পেয়েছি, ইতস্তত পত্র-পত্রিকায় পড়েছি, মনে হয়েছে সুবিমল আরও গদ্য লিখতে পারতেন। তবে তিনি যে একজন সফল গদ্যকার এ-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তিনি হিন্দি কবিতার সঙ্গে পাঠকদের পরিচয় করিয়ে দেন 'প্রতিবেশি জানালায়'। অনুবাদ সাহিত্যেও সুবিমল যে মাহির তা বলাই বাহুল্য।
অনুবাদ সাহিত্যে গল্পের মধ্যে ফণীশ্বরনাথ রেণুর 'তিসরি কসম', শ্রেষ্ঠ গল্প প্রেমচন্দের 'পঞ্চ পরমেশ্বর', 'দুই সখী'। প্রবন্ধ অনুবাদের ক্ষেত্রে 'জীবনসার', হিন্দি কবিতার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সংকলন 'প্রতিবেশিন জানালা'। শ্রীকান্ত বর্মার 'উজ্জয়িনীর রাস্তা', জগদীশ চতুর্বেদীর 'বোবাদের পল্লীতে' যথেষ্ট দাগ কাটে পাঠকদের মনে, কারণ প্রত্যেকটি অনুবাদ-কবিতায় হাংরি কবিতার ঝলক উঁকি মারে। কবিতার জীবনকে সামলাতে না পারলে পড়ে যাবার সম্ভাবনা থেকেই যায় --- পাঠককুলকে তাই খবরদারি, সাবধানবাণী প্রকৃতই চেতাবনি। সুবিমল বসাক ঢাকায় গেছিলেন তাঁদের পৈত্রিক বাড়ির আশে-পাশে যে-সব বুজুর্গরা থাকতেন, তাঁদেরই সান্ধ্য আসরে তাঁদের অনুরোধে লুপ্তপ্রায় এক প্রাচীন শিল্পকলাকে তুলে ধরেছেন। ঢাকার হিন্দু বাঙালিদের 'বিয়ার গীত' ও 'ঢাকাই ছড়া' সংকলনে। খাস কলকাতায় বছর তিরিশ পূর্বেও বিবাহ উৎসবে এসব গানের প্রচলন ছিল, ক্রমশ হ্রাস পেতে-পেতে এসব গান আজ আর কোনো বিবাহ অনুষ্ঠানে শোনা যায় না, হয়তো আর্থ সামাজিক, শহুরে মানসিকতার সঙ্গে খাপ খায়নি, দ্বিতীয়ত এসব গানের উত্তরসূরী তাঁরা রেখে যাননি, তবু এখনও গ্রামাঞ্চলে কোনো প্রাচীনা, বিবাহ উৎসবে আনন্দে উত্তেজনায় গুনগুন করে গেয়ে উঠছেন এই সব গান।তা সুবিমল বসাকের অবদান।
হাংরি আন্দোলনের পুরোধা সুবিমল বসাক প্রকৃত অর্থে বহু বিচিত্র শিল্পগামী। এখনও তাঁকে লিখে যেতে ব্যক্তিগতভাবে অনুরোধ করি। তার কারণ তিনি জানেন এমন গদ্য অথবা কবিতা নেই--- যা পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম ঠাণ্ডাযুদ্ধও থামিয়ে দিতে পারে --- তাই সুবিমলকে অনুরোধ--- লিখুন, আরও লিখুন। থামিয়ে দিন পৃথিবীর ঙাণ্ডাযুদ্ধ ও উলঙ্গ বিবাদ।

ছিটেফোঁটা পত্রিকার বইমেলা ২০০০ সুবিমল বসাক সম্বর্ধনা সংখ্যা থেকে পুনঃপ্রকাশিত

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন